।।ফেস্টিভ্যালের ডায়েরি। দ্বিতীয় দিন -১ এপ্রিল।।

,

পর্ব ১ –

অষ্টম কলকাতা পিপল্‌স ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের দ্বিতীয় দিনটিও ছিল চিত্রনির্মাতা ও উৎসাহী দর্শক সমাগমে জমজমাট। ঋভু ঘোষের শর্ট ফিল্ম “কোহরা” বাস্তবসম্মত ও টানটান একটি গল্পের উপর ভিত্তি করে তৈরি, যা হরিয়ানায় এক পিতৃতান্ত্রিক গ্রামীণ সমাজের দুই বন্ধু রনি আর জয়দেবের জীবনের কয়েকটি দিনকে ঘিরে আবর্তিত। রনি আর জয়দেব শৈশবের বন্ধু ও পড়শি, যদিও তারা ভিন্ন জাতের। ছেলেদুটি পরস্পরকে ভালবাসে। দুই তরুণের প্রেমের সম্পর্কের বিষয়ে গ্রামীণ সভ্যতার বাস্তবতা কত নিষ্ঠুর হতে পারে তার সাক্ষ্য বহন করে এই ছবি। রনির বাবা, প্রভাবশালী এবং হিংস্র স্বভাবের মধ্যবিত্ত জাঠ কৃষক সুরিন্দর, দিনের পর দিন ছেলে এবং স্ত্রীকে অত্যাচার করেন। পারিবারিক হিংসার আবহে কোমল স্বভাবের রনির দমবন্ধ হয়ে আসে। সে তার প্রিয় বন্ধু জয়দেবের কাছে শান্তি খুঁজতে যায়। তাদের সম্পর্ক সুরিন্দরকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। “আমাদের ছেলের দিকে হাত বাড়িয়েছ কোন সাহসে?” প্রশ্ন ওঠে, ও তারপরই গল্পে কিছু অভাবনীয় মোড় আসে, যেখান থেকে দর্শকরা ছবিটিকে নতুন করে ভাবতে শুরু করে এবং ছবির শেষটা দর্শকদের মনে এক অসমাপ্ত জিজ্ঞাসা রেখে যায়।

বাস্তবধর্মী অভিনয় ও সংলাপে ঋদ্ধ এই ছবি আমাদের মনে একটা গভীর অভিঘাত সৃষ্টি করে। “কোহরা”র আক্ষরিক অর্থ কুয়াশা। গ্রামের বাতাবরণ, আবহাওয়া থেকে শুরু করে প্রতিটি চরিত্রের পোশাক, সাজসজ্জা এবং তার সাথে শক্তিশালী একটা চিত্রনাট্য, প্রতিটি চরিত্রের যথাযথ অভিনয় আর পর্দায় উপস্থিতি – সব নিয়ে এই শর্ট ফিল্মটি প্রেক্ষাগৃহে সমবেত দর্শকদের কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ করে দেয়। কোনো আশার ঝলক দিয়ে ছবিটা শেষ হয়না, শেষ হয় পিতৃতন্ত্রের কুৎসিত বাস্তবতা দিয়ে, যা দর্শকদের কাছে এক অস্বস্তিকর ও পীড়াদায়ক আয়না তুলে ধরে।

মনের এই দুঃসহ কুয়াশা কাটবে কবে? এ কথা ভাবতে ভাবতে শুরু হয় এদিনের দ্বিতীয় ছবি। দুঃখ, দারিদ্র, অনটন, তার মাঝে লোকগান ও নদীর বহমানতা এই সব নিয়েই পরিচালক নিখিলেশ মাট্টুর স্বল্পদৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র “ভব নদীর পারে”। সত্যজিত রায়ের “পথের পাঁচালী”-তে যজমানি শেষ করে গ্রামের ভিটেতে ফিরে এসে হরিহর তার ছেলেমেয়ে অপু-দুর্গার সাথে খুনসুটি করে। খানিকটা যেন সেই কালজয়ী দৃশ্যকে সম্মান জানাতে এই ছবির আরেক বাবার তার বাড়িতে ফিরে আসা, তার ছেলে এবং বোবা মেয়েটির সাথে কিছু খুনসুটি করার দৃশ্য চিত্রায়িত করেছেন পরিচালক। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র চপল দুই বাংলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কালিন্দী নদীর পশ্চিমতীরে গুমতে নামে একটি সীমান্তবর্তী গ্রামে বাস করেন। এই তথ্যচিত্রটি তার জীবন ও সঙ্গীতপ্রেমের মাধ্যমে সুন্দবনের গ্রামজীবনের জীবন-জীবিকার সংগ্রামকে ধরার চেষ্টা করেছে। চপল প্রথমে একজন বাবা। তারপর একজন বাঁশি শিল্পী। পেশায় তিনি মৎস্যজীবী। এক দিন তার জীবনে নানা ঘাত প্রতিঘাত ঘটে, আবার পরের দিনই তিনি সুর তোলেন; অন্য দিন ছেলেমেয়েদের আবদার মেটান, আবার সেইদিনই আবদার মেটানোর জন্য টাকা রোজগার করতে ছোটেন; একই জীবনে বহুমুখী অবতারে চপল সফল কিন্তু শিল্পী হিসেবে সাফল্য তার এখনও আসেনি। সেই নিয়েই ভব নদীর পারে তার ছোট্ট সংসার। এটাই এই তথ্যচিত্রের মূল ভাব।

যেকোনো তথ্যচিত্রের মূল ধারক এবং বাহক হল তার চরিত্রের সাবলীল এবং বাস্তব চিত্রায়ন। এই ছবির ক্ষেত্রে চরিত্রদের নিয়ে পরিচালককে হয়তো বা অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়নি। সূক্ষ্ণ সিনেমাটোগ্রাফি এবং মনকাড়া সংগীত ছবিটিকে সমৃদ্ধ করেছে। লোকগীতির দুই প্রধান শিকড় গাজন আর কীর্তন মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে এই ছবিতে। তথ্যচিত্রের চিত্রায়ন কখন যে চপলদের জীবনের চিত্রপটে সূক্ষ্ণ একটা ছাপ ছেড়ে গিয়েছে এই ছবিতে তা সত্যিই বোঝা দায়, কিন্তু চলচ্চিত্র দৃশ্যায়নে “ভব নদীর পারে” ধরে রেখেছে দারিদ্রক্লিষ্ট শিল্পীকুলের ব্যথিত মরম আর কষ্টের চিহ্নগুলো।

সুন্দরবন থেকে ফেস্টিভ্যালের পর্দায় এরপর আমরা পৌঁছে যাই মহারাষ্ট্রের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সমাজে মেয়েদের অবস্থান আর বিয়ের আগে “মেয়ে বাছাই”-য়ের মাপকাঠি কী কী হতে পারে, নাজির খান পরিচালিত তথ্যচিত্র “দ্য নেক্সট টুয়েলভ মান্থস” চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সেই কৃষক সমাজে উপযুক্ত পাত্রী খুঁজে না পাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই ছবিটি আবর্তিত হয়। চার বৃদ্ধের একসাথে কথা বলা এবং সে কথার মাঝখানে সমাজ সংসারের অনেক কিছু চলে আসা, তাদের সমাজের মধ্যের নতুন সমাজকে নিয়ে কিছু কথা এবং নারীদের শিক্ষাসংক্রান্ত কিছু টিপ্পনী এই তথ্যচিত্রের মূল আধার। একটি মেয়ে যার আগে একবার বিয়ে হয়ে গেছে এবং যার একটি সন্তানও আছে; মেয়েটি যদি সেই বিয়েতে অসুখী হয় আর সমাজের চোখে হয় “ডিভোর্সি” তকমাপ্রাপ্ত, তবে তাকে আর কেউ বিবাহ করতে চায় না। এই ধরণের অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে সমাজের একদল বুদ্ধিজীবী বিদ্বানদের বচসা এবং শেষ অবধি মূল চরিত্রের সিদ্ধান্তের টানাপোড়েনে ছবিটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।

“দ্য নেক্সট টুয়েলভ মান্থস” ছবিতে পরিচালক নাজির খান নিপাট সিনেমাটোগ্রাফি, ন্যারেটিভ এবং সর্বোপরি দক্ষ পরিচালনার মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। তথ্যচিত্রের একদম শেষে গিয়ে সমাজের সমস্ত বাধা অতিক্রম করে পরিচালক এমন একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন যা হয়তো দর্শকদের চিন্তাভাবনার বদল ঘটাবে এবং সমাজে এক সদর্থক পরিবর্তন আনবে। সর্বোপরি সকল বাস্তব চরিত্রের সাবলীল চিত্রায়ন এই ছবির উপরি পাওনা।

সমাজ পরিবর্তন বা মানুষের চেতনার পরিবর্তনের নিরিখে যে শিল্পমাধ্যমগুলি আমাদের হাতিয়ার তাদের মধ্যে চলচ্চিত্র এক অতি শক্তিশালী ও সম্ভাবনাময় মাধ্যম। খুব রূঢ় বাস্তবকে তুলে আনার ক্ষেত্রে তথ্যচিত্র এক বড় ভূমিকা পালন করে। “দ্য নেক্সট টুয়েলভ মান্থস” ছবিটিও সেই ভূমিকাই পালন করেছে।

পর্ব ২ –

উৎসবের দ্বিতীয় দিনের দ্বিতীয় পর্বের তিনটি ছবিতে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ তার রূপ, রস, গন্ধ ও যতেক টানাপোড়েন যেন হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে বড় পর্দায়।

শ্রীধর সুধীরের ছবি “মুভিং আপস্ট্রিম গঙ্গা” বহতা নদীর গল্প। গঙ্গা নদীর গল্প। কিন্তু তার চেয়েও বেশি এটি নদীর পারের বাস করা খেটে খাওয়া মানুষের গল্প। এই ছবির চিত্রপরিচালক মানুষের জীবন যাপনের গল্পের খিদে মেটাতে নেমে পরেন রাস্তায়। হেঁটে চলেন নদীর উজান বেয়ে তিন হাজার কিলোমিটারের যাত্রাপথে, মাসের পর মাস, প্রায় দশ মাস। গঙ্গার ধার দিয়ে অবিরাম সেই হাঁটা। নদীর পাল্টানো গতিপথের মত জল-মানুষদের জীবনের টানাপোড়েন। আর সঙ্গে তো আছেই সরকারের মানুষ-বিরোধ। জল বিরোধী, জল-মানুষ বিরোধী সরকারি নীতিনিয়ম। তবে এই চলন যদি হত আরো ধীরে, তবে যেন আরো কাছ থেকে মানুষের জীবনের ধারা বোঝা সম্ভব হত, এমনটিই মনে করে এই ছবিটি শেষ হয় এক অদ্ভুত অভিনব ভঙ্গীতে মানুষের জীবন বোঝার ধরণ দিয়ে। দ্রুতগামী শহুরে ইঁদুর দৌড়ের রেষারেষি থেকে তা যেন বড্ড দূরে।

নেপালের চিত্রনির্মাতা রজন কাঠেত পরিচালিত স্বল্পদৈঘ্যের কাহিনীচিত্র “বেয়ার ট্রিস ইন দ্য মিস্ট” একটি মাইগ্রেশনের গল্প। শুধু তাই নয় এটি একটি অপেক্ষার গল্পও বটে। নেপালের ছোট্ট একটি গ্রামের পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারের গল্প। ছোট্ট বাচ্চাদের অন্তহীন অপেক্ষার কাহিনী। একক নারীদের অপেক্ষার কাহিনী।

“অনেক দিন আগের কথা। যুদ্ধ হয়েছিল এক দূর দেশে। চলে যেতে হয়েছিল গ্রামের সকলকে। সকল পুরুষকে। পড়ে ছিল শুধু গ্রামের মহিলারা। যারা বসে বসে দেখে গেল। দেখে গেল কীভাবে এক এক করে সব প্রেমিকরা হারিয়ে গেল। জঙ্গলের মধ্যে।”

“এমনই একজনের নাম সুসতনা। সুসতনা বসে বসে দিন গুনতে থাকে। কবে তার প্রেমিক ফিরে আসবে তার কাছে। এভাবে অনেক সময় কেটে গেল, অনেক দিন আর অনেক রাত। আর বসে বসে কবে যেন সুসতনার দেহ একটি পাহাড়ে পরিণত হয়ে গেল।”

ঘরছাড়া। গ্রামছাড়া। ঘর ছেড়ে যাওয়ার বাসনা। ঘর ছাড়তে না পারার পিছুটান। এমনি একটি ছোট্ট গ্রামের কাহিনী নিয়ে সৃষ্টি লাখেরার তথ্যচিত্র “এক থা গাঁও”।

উত্তরাখন্ডে এমন হাজারো গ্রাম রয়েছে যেখানে আর কোনো বাসিন্দা নেই আর। ঘর ফাঁকা রয়েছে। ‘ঘোস্ট ভিলেজ’ (ভূতের গ্রাম) হয়ে পড়ে রয়েছে তারা। ৮০ বছরের একজন বৃদ্ধা দেশ ছেড়ে ঘর ছেড়ে কোথায় যে যাবেন জানেন না। তার মেয়ে কাজ করতে চলে গেছে ভিন্ন শহরে। তিনি চান না এভাবে তাকে একা ফেলে রেখে কাজের জন্য চলে যাক কেউ। একই সাথে আমরা একটি ১৬ বছরের তরুণীর গল্প শুনি, শুনি তার চাওয়া পাওয়ার গল্প, কীভাবে এই গ্রামে তার জন্য আর কোনো জীবিকার সুযোগও আর নেই। ভগ্ন সেই ঘর বাড়ির জঙ্গলে নতুন করে গড়ে ওঠার কোনও সুযোগ আর নেই।

পর্ব ৩ –

অষ্টম কলকাতা পিপলস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের দ্বিতীয় দিনের তৃতীয় ভাগে দেখানো হল একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ফিকশন ছবি – “প্রশ্ন”। এক স্বামী-স্ত্রী পরিযায়ী আখ শ্রমিকের কাজ করেন। বাড়িতে আর কেউ না থাকায় খুব স্বাভাবিক ভাবেই আখ কাটার সময়ে তাদের স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে তাদের সঙ্গে জায়গায় জায়গায় যেতে হয়। ফলে তার পড়াশোনার ক্ষতি হয়। ছেলেটির মা অতি অল্প পড়াশোনা জানলেও ছেলেকে শিক্ষিত করার বিপুল প্রচেষ্টা তার মধ্যে দেখা যায়। 

ছেলেটির অন্যান্য নিকট আত্মীয়রা ছেলেটির পড়াশোনা নিয়ে একেবারেই ভাবিত নয়। ছেলেটির মা ছেলেকে শিক্ষিত করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেও পড়াশোনা করার প্রচেষ্টা করতে থাকেন। ছবির মূল সুর এর ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে। ছবির প্রায় শেষ দিকে ছেলেটি তার মাকে একটি প্রশ্ন করে। পুরো ছবির ভরকেন্দ্র দাঁড়িয়ে আছে ওই দৃশ্যের ওপরে। সম্ভবত সেই কারণেই ছবির নাম “প্রশ্ন”।

স্বাধীনতার পচাত্তর বছর পরেও দেশে নারীশিক্ষার হার শোচনীয়। মহিলাদের সাক্ষরতার হার পুরুষদের থেকে অনেক কম। সেখানে দাঁড়িয়ে এই ছবি নারীশিক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরে। যতই “বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও” এর ফাঁপা স্লোগান দেওয়া হোক না কেন; আদতে মূল বিষয়টি উপেক্ষিতই রয়ে গেছে।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নজর কেড়েছে এই ছবিতে। সেটি হল পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবন। কোভিড জনিত লকডাউনের সময়ে এই “পরিযায়ী শ্রমিক” শব্দবন্ধ প্রচারের আলো পায়। বহু মানুষ পেট চালানোর জন্য নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্য রাজ্যে এমনকি অন্য দেশেও পাড়ি জমান। লকডাউনের সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থা গোটা দেশ দেখেছে। সরকারি অপদার্থতায় হাজার হাজার কিলোমিটার হাঁটতে হাঁটতে পরিযায়ী শ্রমিকরা মারা পড়েছেন। শিশুকে কোলে নিয়ে পরিযায়ী শ্রমিক মা বাবারা হাজারো মাইল হেঁটে বাড়ির পথ ধরেছেন। এসব হৃদয়বিদারক দৃশ্য আমরা দেখেছি। পদে পদে লঙ্ঘিত হয়েছে তাঁদের মানবাধিকার। এই ছবি পরিযায়ী আখ শ্রমিকদের জীবন এবং তাঁদের সন্তানদের ওপর সেই জীবনের প্রভাব দেখায়। কীভাবে শিক্ষার অধিকার থেকে শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কারণে; সেটা চোখে আঙুল দিয়ে তুলে ধরে। পিপলস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের মূল সুরের সঙ্গে যে ছবিটি মিলে গেছে তা দর্শকদের অভিব্যক্তি দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো।

“প্রশ্ন” ছবিটির পর দেখানো হল তথাগত ঘোষের স্বল্পদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র “দ্য স্কেপগোট” বা “ধুলো”। বর্তমান ভারতে ক্রমাগত বাড়তে থাকা মুসলিমবিদ্বেষ এবং নারীবিদ্বেষের বিরুদ্ধে তৈরি হয়েছে সপাট এই সিনেমা। বাংলা ভাষায় তৈরি এই ছবি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক মনোভাবের কথা বলে। ছবির নাম আক্ষরিক এবং রূপক; দুই ভাবেই সার্থক।

ছবিতে ব্যবহৃত বেশ কিছু রূপক দর্শকদের চোখ টেনেছে। যেমন, “হিন্দু নেতা”-র কথায় কথায় বলা “জয় শ্রীহরি” দর্শকদের “জয় শ্রীরাম”-এর কথা মনে পড়ায়; যে স্লোগান দিয়ে এদেশে গণপিটুনি দেওয়া হয়, বা যে ধ্বনি জোর করে বলানোর জন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। চিত্রনাট্যের একটি ঘটনা মনে করিয়ে দেয় দাদরিতে মহম্মদ আখলাককে পিটিয়ে মারার ঘটনাটিকে। মনে করিয়ে দেয় গণপিটুনিতে মৃত আফরাজুল ইসলামকে। হিন্দুনেতার মোটরগাড়িতে লাগানো গেরুয়া পতাকায় অশোক স্তম্ভের আদলে তিনটি গরুর চিহ্ন দেখা যায়; যা স্পষ্টতই এদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে।

ভারতে হিন্দু-সংখ্যাগুরুবাদ যে কেবল সংখ্যালঘু মুসলিমদের প্রতিই ঘৃণা বর্ষণ করছে এমনটা নয়। যে কোনও ফ্যাসিস্ট মতাদর্শের মত এটিও তীব্র নারীবিদ্বেষী যা নারীদের পুরুষদের সমকক্ষ বলে মনেই করে না। এমন স্বামীকে দেখানো হয়েছে যে স্ত্রীকে অত্যাচার করে, স্ত্রীকে বাইরে কাজ করতে দেখলে যে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। আমরা দেখেছি ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে এদেশের মহিলাদের মরণপণ লড়াই; সে শাহীনবাগ হোক কিংবা পার্ক সার্কাস। এই ছবিতেও দেখা যায় মেয়েদের সেই লড়াই, একটি মেয়ের আরেকটি মেয়ের পাশে শেষতক দাঁড়ানো, এবং শেষপর্যন্ত সে পথেই উত্তরণের কথা বলেই এই ছবি শেষ হয়। কানায় কানায় ভর্তি প্রেক্ষাগৃহ বুঝিয়ে দিচ্ছিলো যে ছবির সঙ্গে দর্শকরা একাত্ম বোধ করছেন।

ছবির শেষে পরিচালক তথাগত ঘোষ দর্শকদের সঙ্গে কথা বলেন এবং ছবির বিষয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর দেন।

এর পরের ছবিটি দেবাশিস মাখিজা পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র “সাইকেল”। সাইকেল শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হল চক্র। যে ঘটনাক্রম কখনও শেষ হয় না, বরং সময়ে সময়ে পুনরাবৃত্ত হয়; তাকে সাধারণত চক্রাকার ঘটনা বলা হয়। “সাইকেল” ছবিটিও এরকমই এক চক্রাকার পুনরাবৃত্তের কথা বলে।

এই কাহিনিচিত্রের চিত্রায়ন বেশ অভিনব। তিনটে লং শটে পুরো ছবিটা তোলা হয়েছে, যেগুলোর প্রত্যেকটা দেখেই মনে হবে মোবাইল ক্যামেরায় তোলা সাধারণ ফুটেজ। আজকাল এদেশে গণপিটুনি, সংখ্যালঘু মানুষকে পুড়িয়ে মারা, বা আদিবাসীদের ওপর সেনাবাহিনির হিংসার ভিডিও মোবাইলে তুলে রাখা হয় ‘ট্রফি ভিডিও’ হিসাবে। ছবির প্রথম দৃশ্য শুরু হয় এরকমই একটি ‘ট্রফি ভিডিও’ দিয়ে। ছবির গল্প এগোলে বোঝা যায় এই ধরণের চিত্রায়ন কেন প্রয়োজন ছিল। এই চিত্রায়ন ছবিটিকে জ্যান্ত বাস্তবের মাত্রা দেয়।

“সাইকেল” ছবিটি দেখায় কীভাবে রাষ্ট্রীয় অত্যাচারের ফলে সমাজের প্রান্তিক আদিবাসী মানুষরা হাতে অস্ত্র তুলে নিচ্ছেন। যারা হাতে অস্ত্র তুলে নিচ্ছেন; তারা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও ভাবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার এবং তারা কেউই সুবিচার পাননি। হাতে বন্দুক তুলে কাউকে হত্যা করতে গেলে যে কঠোর, নির্মম মন প্রয়োজন হয় – তা তৈরি করার পিছনে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভূমিকার কথাই স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে এই ছবিতে।

ছবিটা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলে। সেটি হল প্রতিহিংসা। আজকের সমাজে দাঁড়িয়ে যখন প্রতিহিংসা বেশ বাজারচলতি একটি বিষয় হয়ে উঠেছে, যখন প্রতিবেশী দেশ কিংবা প্রতিবেশী মানুষদের প্রতি হিংসা এখন ভোট চাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলির অন্যতম পুঁজি। সেখানে এই ছবি প্রতিহিংসার ভয়াবহতাকে পরিষ্কার ভাবে ফুটিয়ে তোলে।

ছবির শেষ দৃশ্যে হাতে অস্ত্র ধরা এক মহিলা চিৎকার করে বলে ওঠেন, “দেখ, তোরা কী বানালি আমায়”। এই সংলাপ সরাসরি দর্শকদের বিদ্ধ করে, অন্যরকম ভাবে ভাবতে বাধ্য করে। কে তাদের এরকম বানালো, কারা সব দেখেও মূক দর্শক হয়ে মুখ ফিরিয়ে নির্লিপ্ত থাকলো, এই সব অস্বস্তিকর প্রশ্ন মনে ঝড় তোলে, যেন সব দর্শককেই এর কারণ খুঁজতে বলে। সমাজের সবথেকে প্রান্তিক, নিপীড়িত মানুষদের অধিকার নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে এই ছবি। ছবি চলাকালীন প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের মুখভঙ্গি বলে দিচ্ছিলো এই কাজে ছবিটি সফল এবং একইভাবে “মানুষের অনুদানে মানুষের সিনেমা” দেখানোর উদ্দেশ্য নিয়ে আয়োজিত কলকাতা পিপলস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালও সফল।

ছবির শেষে ছবির সাউন্ড ডিজাইনার দিবাকর সাহা ছবির বিষয়ে আলোচনায় অংশ নেন এবং দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।

পর্ব ৪ –

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক উমা চক্রবর্তী অতীত সময়ের ভাষ্যকার শুধু নন, তিনি ও তাঁর ‘পেনশন পিকচার্স’ ছবিবদ্ধ করে রাখতে চায় এমন সব গল্পকে যা আমাদের বর্তমান সময়কেও ভাবিত করে। উমাদির ক্যামেরা আসলে ‘ওরাল হিস্ট্রি’-র ধারক। এবং মেয়েদের চাপা-দেওয়া-ইতিহাস খুঁড়ে বের করতে আজও, এই বয়সেও তিনি ক্লান্তিহীন। অষ্টম কলকাতা পিপলস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের দ্বিতীয় দিনের শেষ ছবি উমা চক্রবর্তী ও প্রিয়াঙ্কা ছাবড়া-র “ইয়ে লো বয়ান হামারে” বা “অ্যান্ড উই ওয়্যার দেয়ার ১৯৬৭-১৯৭৭”-এ আমরা ফিরে দেখি আজ থেকে পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর আগের নকশাল আন্দোলনকে যা প্রকৃত অর্থেই যৌবনের ডাক ছিল। বাঙালির “মাধবীলতা” ফেটিশ যে পরিঘটনাকে এ যাবৎকাল সিনেমার পর্দায় বা কৌমস্মৃতিতে আড়াল করে রেখেছে তা সজোরে উঠে আসে এ ছবিতে – তা হল এই আন্দোলনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে যুবক ও যুবতীদের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনার দিক থেকে কোনও ভাগ ছিল না। অন্তত যুবতীরা নিজেরা তা মনে করতেন না। ‘অ্যাকশন’ তারাও করতে জানতেন। যদিও তাদের জবাবদিহি করতে হত। পুরুষ কমরেডদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিপ্লবের স্বপ্ন চোখে মেখে, গ্রামে গ্রামে কৃষক-শ্রমিকের ভিড়ে মিশেও তারা টের পেতেন আসলে তারা শুধু মেয়ে বলেই তাদের আলাদা করে দেওয়া হয়! সমাজটা তো সেই ভারতীয় সমাজ আসলে। এখানে মেয়েদের সংগ্রামের আলাদা মূল্য নেই, তাই সাংস্কৃতিক মাধ্যম যেভাবে কৌমস্মৃতিকে ধরে রাখতে চায়, সেখানেও সেই সব সাধারণ বিপ্লবী মেয়েদের ইতিহাসকে প্রান্তে সরিয়ে দেওয়া। তবে আমরা এ ছবির কাছে ঋণী কারণ এই নির্মাণ থেকেই আমরা জানতে পারি ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৭-এর দশকগুলোয় নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষিতে কত না মেয়ে জেল খেটেছে। জেলের অত্যাচারের পাশে আমরা ‘অকথ্য’ শব্দ বসাই কখনও কিন্তু পর্দায় জয়া মিত্র, কৃষ্ণা ব্যানার্জি, রাজশ্রী দাশগুপ্ত, মীনাক্ষী সেন বা মীরাদেবী যখন সেসবের বর্ণনা দেন তখন ওই শব্দকেও ম্লান মনে হয়। তাদের পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের দিনগুলোর কথা উঠে আসে, যখন দিনের পর দিন স্নান করতে দেওয়া হত না, হাত-পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হত কিংবা মুচলেকা দিতে বলা হত, তখনও তারা হার মানতেন না। সেই পুলিশি নির্যাতন পেরিয়ে, বাকি শত শত ছেলেমেয়েদের মত খুন না হয়ে মরে না গিয়ে আজ ক্যামেরার সামনে তাঁদের বসতে পারাটা অসীম সাহসের পরিচয় দেয়। উঠে আসে জেলের ভেতর অন্যান্য সাধারণ মেয়ে বন্দীদের কথা। তাদের মানবিকতার মরমিয়া কাহিনি। স্মৃতিচারণে ভরা এই ডকুমেন্টারি ক্রাফটের দিক থেকে পরীক্ষানিরীক্ষা বিশেষ করেনি। ছবির শুরুতে দেখানো জেলের ‘ইন্টারভিউ রুম’। যেন সেখান থেকে উল্টো মেরুতে, সরাসরি দর্শকের চোখে চোখ রেখে সোজাসাপটা চিত্রায়িত বয়ানগুলিই আমাদের কশাঘাত করে, তারাই নিজের কাঁধে এ ছবির ঐতিহাসিক গুরুত্বকে ধারণ করে।

ছবিটির প্রথম পর্বে যেমন নকশাল আন্দোলন, ছবির দ্বিতীয়ভাগে ইন্দিরা গান্ধীর ‘জরুরী অবস্থা’-র সময় মেয়েদের জেলে পোরার কাহিনি উঠে আসে। বাংলা ও বিহার পেরিয়ে ভারতবর্ষের নানা রাজ্যের মেয়েদের কথা তুলে আনে ছবির ক্যামেরা। অন্ধ্রপ্রদেশ, বোম্বে, ব্যাঙ্গালোর। সব মিলিয়ে পনেরোজন মেয়ের জেলজীবনের অভিজ্ঞতাড় সূত্রে উঠে আসে ১৯৬৭-১৯৭৭ দশকের ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস। ছবির শেষে পরিচালকের সাথে কালেকটিভের তরফে কস্তুরী বসু দীর্ঘ আলোচনা করেন, দর্শকরাও যোগ দেন। তবে ‘ইয়ে লো বয়ান হামারে” বা “অ্যান্ড উই ওয়্যার দেয়ার ১৯৬৭-১৯৭৭” কিন্তু অতীতের কাহিনি কিছুতেই নয় শুধু। এই কাহিনি ভীষণভাবে হাড়হিমকরা বর্তমান। আজও সোনি সোরিকে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতিত হতে হয়, সুধা ভরদ্বাজ, সোমা সেন, হিডমে মরকম, ঠাকুরমণি মুর্মুদের জেলবন্দী থাকতে হয়। শুধু ভারতের অন্যত্র নয়, খোদ পশ্চিমবঙ্গের জেলে বহু আদিবাসী মহিলা আটক। কেন? কারণ, তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস, তাদের রাজনৈতিক চেতনা সরকারি বয়ানের সাথে মেলেনা। অতএব, পঞ্চাশটি বছর ও পঞ্চাশ বছরের মানবাধিকার আন্দোলন পেরিয়েও ক্ষমতাকাঠামোটার, ব্যবস্থাটার পরিবর্তন হয়নি। জেলবন্দি মেয়েদের কাহিনি আজও অনেকাংশেই প্রান্তিক। অন্যতর ইতিহাস হয়তো বা কোনও একদিন ছবিতে লেখা হবে।

লেখা – স্নিগ্ধদেব, সব্যসাচী, শ্রেয়তমা, ভাস্কর

ছবি – নিবেদিতা

অষ্টম কলকাতা পিপল্‌স ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল

৩১শে মার্চ – ৩রা এপ্রিল ২০২২

উত্তম মঞ্চ, হাজরা

প্রবেশ অবাধ

0 replies

Leave a Reply

Want to join the discussion?
Feel free to contribute!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *