পর্ব ১ –
এক বছরের বিরতি পেরিয়ে শুরু হয়ে গেল অষ্টম কলকাতা পিপলস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। হাজরার উত্তম মঞ্চ এই চারদিন লোকারণ্য থাকবে। মাঝখানের একটি বছরের অনুপস্থিতি মাত্র। ভার্চুয়ালে কি এই ম্যাজিক, এই মাতামাতি, এই উত্তেজনা থাকে? আটতিরিশটি ছবির মধ্যে উদ্বোধনী ছবি পাকিস্তানের ‘ডিসকাউন্ট ওয়ার্কার্স’। অমর আজিজের প্রথম ছবি ‘ওয়ালনাট ট্রি’-ও এই চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছিল কিছু বছর আগে। অমর মানুষের পিছু পিছু ক্যামেরা নিয়ে ছুটতে জানেন। নিপীড়িত মানুষের মুকুর হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে অমরের ছবি। আট বছর আগে পাকিস্তানের করাচিতে একটি গার্মেন্টস কারখানায় ঘটে যায় মারাত্মক অগ্নিকান্ড। নিহত হন প্রায় ২৫৯ জন মানুষ। এবং এই ঘটনাকে একেবারেই খুন বলা চলে তার কারণ সেখানে কোনও ফায়ার-এক্সিট ছিল না। কত শত তরুণের যে অবলীলায় প্রাণ চলে গেল তার ইয়ত্তা রইল না। শুধু যে প্রাণ গেল তা নয়, জীবনগুলো যেন কেবল সংখ্যা হয়ে রইল। এমনই এক তরুণের মা সঈদা খাতুন কিন্তু হাল ছাড়লেন না। লেবার কোর্ট থেকে, হাইকোর্ট আর সেখান থেকে এমনকি জার্মান কোম্পানি কিকা-এর দরজায় আঘাত হানলেন। ঘর থেকে বেরোতে না পেরে দম আটকে দগ্ধে দগ্ধে যাঁর সন্তানকে মরতে হয় তিনি হার মানবেন কেন? ইউএন পর্যন্ত গিয়ে নিজের কাহিনী, নিহত সমস্ত সন্তানের কাহিনী, বিপর্যস্ত পরিবারগুলোর কাহিনী ও সংগ্রামের কথা তুলে ধরলেন একা সঈদা। ছবির নির্মাণ এক কথায় অসাধারণ। পরতে পরতে কাব্য আবার কঠোর বাস্তব। সব থেকে বড় কথা শ্রমিকের লড়াইয়ের প্রশ্নে আসলে যে পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ বা উপমহাদেশের সব দেশই কমবেশি এক তা আমাদের পরিস্কার করে দেখিয়ে দেয় ‘ডিসকাউন্ট ওয়ার্কার্স’।

এ তো গেল পাকিস্তানের কথা এবং এক সংগ্রামী মায়ের কাহিনী। আচ্ছা, বাংলাদেশ আর কোরিয়ার কি মিল থাকতে পারে? আসলে নারীর প্রশ্নে, তাকে শুধুমাত্র ভোগ্যবস্তু হিসেবে দেখার প্রশ্নে বোধ হয় সব দেশই এক। সাংস্কৃতিক আবহে যে এই দুই দেশ খুব কাছাকাছি তা নয় কিন্তু যুদ্ধ এবং নারীর দখলে সকলে এক। শেখ আল-মামুন বাংলাদেশের মানুষ হলেও তিনি ২০০৯ সাল থেকে কোরিয়ার নাগরিক। কোরিয়ার ‘পিস স্ট্যাচু’-এর সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর মনে পড়েছিল বাংলাদেশের বীরাঙ্গনাদের কথা। হায়! কী হাস্যকর ও নিষ্ঠুর শব্দ এই ‘বীরাঙ্গনা’। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় আড়াই-তিনলাখ নারী ধর্ষিত হন। সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে তার কারণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মূল লক্ষ্য ছিল খুন ও নারীধর্ষণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে নিকেষ করা। বহু নারী সেই পাশবিক অত্যাচারের বলি হলেও সে তো কয়েক মিনিট, কয়েক ঘন্টা বা কয়েক দিনের ব্যাপার ছিল কিন্তু সেই সূত্রে যে সামাজিক নিগ্রহ এই সমস্ত নিরপরাধ মেয়েদের ওপর নেমে এল, বয়ে চলল বছর পঞ্চাশ তা সত্যিই সহ্যাতীত। বাবা মেয়েকে তাড়িয়ে দিল, স্বামী স্ত্রীকে ছেড়ে পালাল, সন্তান আজও মাকেই দোষারোপ করে। অথচ, তাও সে ‘বীরাঙ্গনা’! এমনই ভাগ্য কোরিয়ার মেয়েদেরও হয়েছিল। জাপান যখন কোরিয়া দখল করে তাদের সেনাবাহিনীর ‘কমফোর্ট উইমেন’ হতে হয়েছিল কোরিয়ার অগণিত নারীদের। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় কেউ কেউ। যখন সাতান্ন আটান্ন বছর পর ফেরে তখন আর তার আপনজন বলতে কোনও মানুষ আর বেঁচে নেই! সব থেকে বড় কথা এমন নিকৃষ্ট অত্যাচার পরাধীন বাংলাদেশ এবং কোরিয়ার মেয়েদের ওপর নেমে এলেও দেশ স্বাধীন হবার পর কখনওই কোনও পক্ষ সেই ভুল স্বীকার করে না। পরবর্তী প্রজন্ম একবার ক্ষমা পর্যন্ত চায় না। হয়ত সেকারণেই ‘বীরাঙ্গনা’ বা ‘কমফোর্ট উইমেন’-রা ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যায়।

উৎসবের এই প্রথম দিনে প্রথম ফিকশন ফিল্ম, ‘আশাও কে পার’। ডিরেক্টর রোহিত কুমার পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ছাত্র। তাঁর এই কুড়ি মিনিটের ছবিতে আমরা দেখি গ্রাম থেকে একটি ছেলে মুম্বাই শহরে কাজ করতে এসেছে। পরিবারের প্রথম গ্র্যাজুয়েট সে। কিন্তু বড় শহরে এসে সে টের পেয়েছে জায়গাটা, তার জীবনটা এত সহজও নয়। সে তার লেবার সুপারভাইজারের কাজে মোটেই খুশি নয়। সে তাকিয়ে থাকে সেইসব আকাশচুম্বী ফ্ল্যাটগুলির দিকে। কোনও একটাতে হয়ত তার বস থাকে বা বসের ভাই। আর এইসব গল্পই সে তার স্ত্রীকে জানায় যেদিন তার স্ত্রী তার কাছে থাকতে আসে। অচেনা রাস্তা দিয়ে, সমুদ্রের ধার দিয়ে দুটিতে হেঁটে চলে আর চলে তাদের গল্প। অসাধারণ কিছু ছবি আর সিনেমাটিক মুহূর্ত তৈরি হয় যা বহুদিন মনে থাকবে। আর থাকবে ভালবাসা ও স্বপ্নের সত্যিকারের আশাগুলো।

মধ্যাহ্ন বিরতির আগে শেষ ছবি, এটিও ফিকশন, পৃথ্বীরাজ দাশগুপ্তের ‘গ্রীন ব্ল্যাকবেরিজ’। ভারতবর্ষ শিক্ষার ব্যাপারে এক সাংঘাতিক উদাসীন দেশ। সকলের জন্য শিক্ষা নেই, শিক্ষা বিনামূল্যে নয় আর স্কুল যেতে হয় এমনকি নদী পার করেও! এই ছবির দুই বোন নিশা আর নিমাকেও নদী পেরিয়ে, নিজেদের বোটে স্কুল যেতে হয়। তবু তারা স্কুল কামাই করে না। নিশা তো এবার পরীক্ষা হলে স্কলারশিপও পেতে পারে। ছবির শুরুতে একটি বাঁধা, কচি ছাগলের চিৎকার আর ছেলেমেয়েদের একসুরে পড়াশোনা করে যাবার দৃশ্যটি অনন্যসাধারণ। আরেকটি দৃশ্য চোখ টেনে রাখে- নিমা আর নিশা পড়া মনে করতে করতে নৌকার দাঁড় বাইছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমাদের ছোটনদী চলে বাঁকে বাঁকে’ বলতে বলতে দুই বোন এগিয়ে যায় আর আকাশ-বাতাস-পাহাড় যেন সেই পড়া মুখস্থ করতে থাকে তাদের সাথে। তারা বিপদসঙ্কুল পথ পেরোয়, স্কুলে দেরি করে হলেও পৌঁছয় কিন্তু পরীক্ষা সেদিন হবে কি? কি জানি! ভারতবর্ষে ইলেকশনের থেকে বেশি গুরুত্ব ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা, স্কলারশিপ আর শিক্ষা কবেই বা পেয়েছে?

পর্ব ২ –
ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং। ভারতবর্ষের অন্যতম বড়ো একটি সমস্যা। ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং বলতে মূলত মানুষের দ্বারা ময়লা নিষ্কাশনকেই বোঝানো হয়ে থাকে- যা আইন মোতাবেক ভারতে নিষিদ্ধ। তা সত্ত্বেও ভারতের বহু স্থানে ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং চালু আছে। একটি সূত্র অনুযায়ী ২০১৬ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং করতে গিয়ে ৪৭২ জন মারা গেছেন। একইসঙ্গে এই ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিংয়ের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে জাতিভিত্তিক বৈষম্য। এই নিয়েই গুজরাতের ডিনোটিফায়েড ট্রাইব জনগোষ্ঠীর চিত্রনির্মাতা দক্ষিণকুমার বজরঙ্গে (চারা)-র তথ্যচিত্র “দ্য লাস্ট ম্যান” দেখানো হল অষ্টম কলকাতা পিপলস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের প্রথম দিনে, মধ্যাহ্ন বিরতির পর।

ভারতে প্রায় দশ লক্ষ ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জার রয়েছেন। তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের কথা ফুটে উঠেছে এই ছবিতে। পরিচালকের ক্যামেরা ঘুরে বেরিয়েছে সেই সমস্ত স্থানে যেখানে ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জারদের কাজ করতে হয়। ম্যানহোলের ভিতরে, শৌচালয়ে উঁকি দিয়েছে ক্যামেরা। ইচ্ছাকৃত অদ্ভুত এক অস্বস্তি তৈরি করেছেন পরিচালক- যা ছবির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। ছবিতে উঠে আসে ম্যানহোলে ঢুকে মারা যাওয়া ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জারদের নিকটজনেদের কান্না, তাদের অসহায়তা। একইসঙ্গে উঠে আসে কঠিন পরিস্থিতিতে এই কাজ করতে বাধ্য হওয়ার কাহিনী।

ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং এবং জাতিভিত্তিক বৈষম্য ঠিক কীভাবে জড়িয়ে আছে; সে কথাও স্পষ্ট ভাবে উঠে এসেছে এই ছবিতে। কেন এই কাজ তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষদেরই করতে হয়- সরাসরি উঠে আসে এই প্রশ্নও। ভারতের আইন ব্যবস্থা এবং ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং এর বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়েছে ছবিতে।

খোলা ম্যানহোলের দৃশ্য তার সঙ্গে চন্দ্রযান ২ উৎক্ষেপনের দৃশ্যকে একসঙ্গে দেখিয়ে এই ছবি সজোরে ধাক্কা দেয় প্রত্যেক দর্শককে। এই দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই দ্বন্দ্বকে সম্ভবত এর থেকে ভালোভাবে আর ফুটিয়ে তোলা যেতো না। সর্বোপরি এহেন চিত্রায়ন এই ছবিকে একঘেঁয়ে তথ্যচিত্রের পরিধি থেকে বার করে আনে। পিপলস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল সমাজের যে অংশের মানুষের কথা তুলে ধরতে চায় ঠিক সেরকম অংশের মানুষদের নিয়েই তৈরি দ্য লাস্ট ম্যান। ছবি চলাকালীন প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের একাগ্রতা এবং নিশ্চুপতা এর প্রমাণ দিচ্ছিলো। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মতে যারা ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং করেন তাঁরা এই কাজ করে সুখের অনুভূতি পান। এই বক্তব্য সরাসরি একটি বাচ্চা মেয়ের সামনে ফেলে দিয়ে পরিচালক জানতে চান যে নরেন্দ্র মোদী কেন এই কথা বলেছেন। বাচ্চা মেয়েটি; যার দাদু এবং দিদা ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জার; উত্তর দেয়- “কারণ নরেন্দ্র মোদী চান কাজগুলো হোক”।

বাচ্চাটির সরাসরি দেওয়া এই উত্তর মনে করিয়ে দেয় উলঙ্গ রাজা কবিতার সেই বাচ্চাকে যে চিৎকার করে উলঙ্গ রাজাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো,”রাজা, তোর কাপড় কোথায়?”

পর্ব ৩ –

“তারা এদেশ ভাগ করেনি দেয়নি কোথাও খড়ির দাগ,
নেতারা সব ঝগড়া করেন জলে কুমির ডেঙায় বাঘ।”

সমর্থ মহাজনের তথ্যচিত্র বর্ডারল্যান্ডস দেখতে গেলে বারবার করে এই লাইনগুলো মনে পড়ে। ছয়জন চরিত্র; যাদের জীবনে রাষ্ট্রের সীমান্ত কোনও না কোন ভাবে প্রভাব ফেলেছে; তাদের নিয়েই তৈরি এই তথ্যচিত্র, যা দেখানো হল অষ্টম কলকাতা পিপলস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের প্রথম দিনের বিকেলের পর্বে।

বর্ডার ভূখণ্ডকে ভাগ করে। মানুষকে ভাগ করতে পারে কি? এই প্রশ্নের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে বর্ডারল্যান্ডস। ছয়জন চরিত্র; যাদের কেউ গৃহবধূ, কেউ ছাত্রী, কেউ চাকুরীরতা কেউ বা চিত্রপরিচালক। ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনই মহিলা। লিঙ্গভেদে এই অনুপাত বোধহয় পরিচালকের ইচ্ছাকৃত।

কোনও দেশে যখন অন্য একটি ভূখণ্ড যুক্ত হয়; সেই ভূখণ্ডের মানুষরাও কি একইভাবে ওই দেশের সঙ্গে যুক্ত হয়? কিংবা একটা দেশ যখন ভাগ হয়; দুই দেশের মানুষেরও কি ভাগ হয়ে যায়? এই ছবির চরিত্রদের জীবনে সীমান্ত বড়ো ভূমিকা পালন করেছে। সীমান্তর জন্য তাদের জীবনের দুঃখ ছবির পরতে পরতে উঠে এসেছে। একইসঙ্গে উঠে এসেছে তার মধ্যে থেকেই জন্ম নেওয়া মানবিক সম্পর্কের গল্পগুলো। অন্য দেশ থেকে পাচার হয়ে আসা মেয়েকে আমরা দেখি অন্য মেয়ের প্রেমে পড়তে। কাঁটাতারের এপার থেকে ওপারে লাঠির আগায় বেঁধে প্রিয়জনকে দেওয়া উপহার বারবার করে প্রশ্ন তুলে দিয়ে যায়- সীমান্তের কি সত্যিই প্রয়োজন আছে?

এনআরসি, সিএএ, এনপিআর- এই শব্দগুলো এখন ভীষণ পরিচিত শব্দ। নাগরিকত্ব বিষয়ক আন্দোলন তীব্র গতি পেয়েছিলো ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ হওয়ার পর; যে আইন ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্বকে ভাগ করে। এ’দেশে নেতানেত্রীদের মুহুর্মুহু হুঙ্কার শোনা যায় সহনাগরিকদের দেশছাড়া করার। অনুপ্রবেশকারী তকমা দিয়ে আসামে অসংখ্য মানুষকে ডিটেনশনে সেন্টারে বন্দি করার ঘটনাও অজানা নয়। আসামে এনআরসি থেকে ঊনিশ লক্ষ মানুষ বাদ পড়ে বেনাগরিক হয়েছেন। এ’রকম সময়ে দাঁড়িয়ে বর্ডারল্যান্ডস মানুষের গল্প বলে- দেশের সীমানার উর্দ্ধে উঠে।

কলকাতা পিপলস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল “মানুষের সিনেমা” দেখাতে চায়। এই ছবি বাস্তবিক মানুষের সিনেমা হয়ে উঠেছে; সমস্ত গন্ডি ছাড়িয়ে।

পর্ব ৪ –
অষ্টম কলকাতা পিপলস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ২০২২ এর প্রথম দিনের চতুর্থ ভাগে প্রারম্ভিক বক্তব্য রাখেন পিপলস ফিল্ম কালেক্টিভের সংগঠক এবং তথ্যচিত্রনির্মাতা কস্তুরী বসু। কোভিডের ধাক্কায় গতবছর কলকাতা পিপলস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। পিপলস ফিল্ম কালেক্টিভের সমস্ত কাজ গত দুই বছর ধরে আটকে ছিল। এই নিয়েই বিশদ বক্তব্য রাখেন কস্তুরী। গত দুই বছর ধরে ফিল্ম স্ক্রিনিং, অনুদান সংগ্রহ সহ সমস্ত কাজই স্তব্ধ হয়ে ছিল। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই পিএফসি-র তহবিল তলানিতে। কস্তুরী প্রত্যেককে আর্থিক সাহায্য করতে অনুরোধ করেন। কলকাতা পিপলস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের উদ্দেশ্য নিয়েও বিশদে বক্তব্য রাখেন তিনি। বর্তমানে ফ্যাসিস্টদের রমরমার সময়ে কী ভাবে সিনেমাকে প্রোপাগান্ডা হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে; উঠে আসে সে কথাও। গতকাল কেন্দ্র সরকার চারটি সরকারি ফিল্ম আর্কাইভকে বন্ধ করার ঘোষণা করেছে। নিজের বক্তব্য এই ঘোষণার বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ ব্যক্ত করেন কস্তুরী। জনগণের চাঁদায় জনগণের সিনেমা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আবেদন রেখে কস্তুরী নিজের বক্তব্য সমাপ্ত করেন।

প্রারম্ভিক বক্তব্যর পরে প্রখ্যাত তথ্যচিত্রনির্মাতা আনন্দ পট্টবর্ধনের স্বল্প দৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র ‘হার্ট টু আর্ট’-এর বিশেষ স্ক্রিনিং হয়। এই তথ্যচিত্রটির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার সম্পন্ন হল এই ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। শিল্পকলাকে যে সীমান্তের মধ্যে বেঁধে রাখা যায় না; তা’ প্রতিভাত হয়েছে এই ছবিতে। কিছু শিল্পকর্ম; যা ভারতের গন্ডি পেরিয়ে পড়শি দেশ পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেই নিয়ে একটি প্রদর্শনী আয়োজন করা হয় পাকিস্তানে। সেই নিয়েই এই তথ্যচিত্র। প্রসঙ্গত, এই ছবিটা তোলা হয়েছিলো ২০০৪ নাগাদ।
পড়শি দেশের প্রতি ঘৃণা, রাগ, ক্ষোভ এখন বেশ সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছে। এই ক্ষোভকে উস্কানি দিয়ে ভোট বাক্সে তার প্রভাব ফেলার চেষ্টা হয় অনবরত। এই ছবি দাঁড়িয়ে আছে ঠিক এর উল্টোদিকে যা সবকিছু উর্দ্ধে সম্প্রীতির বার্তা দেয়। ওই প্রদর্শনীর বেশ কিছু ছবিকে দেখানো হয় সিনেমা জুড়ে। সেখানে দেখা যায় গান্ধীজিকে নিয়ে আঁকা একটি ছবি। ছবির শিল্পী পরিচালকের ক্যামেরার সামনে নিজের বক্তব্যও রাখেন। ওই ছবিটি গান্ধীজির অহিংসার সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে বলে। দেশভাগের সময়ে গান্ধীজি কী ভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার কাজ করেছিলেন; উঠে আসেন সে কথাও। ফ্যাসিবাদ বিরোধী পিপলস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সঙ্গে এই ছবি সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

পর্ব ৫ –
জীবনে প্রথমবার কখন জাতপাত অনুভব করা যায়? জাতিগত পরিচয়ের জন্য কারণে কী পাওয়া যায় বা হারিয়ে যায়? কেউ কিভাবে জাত ব্যাপারটা নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে ? কি লোকাতে হয়? কি উদযাপন করা হয়? এটা প্রত্যাখ্যান করা কি সম্ভব? ব্যক্তি এ ব্যাপারে কতটা সচেতন? ব্যক্তির দ্বারা আত্মদর্শন কতটা সম্ভব? ব্যক্তিকতটা সত্য হতে পারে?

তামিলনাড়ুর চিত্রপরিচালক আমুধন আর পি-র ছবি ‘মাই কাস্ট’-এ সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের বক্তব্য উঠে এসেছে তাঁদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা মারফত যা দর্শক মননে জায়গা করতে বাধ্য।

পরিচালক জানিয়েছেন জনমানসে চেতনার আধিপত্য এবং সম্মতিনির্মাণের উপর তাঁর ট্রিলজির অংশ হিসাবে ‘মাই কাস্ট’ দ্বিতীয় চলচ্চিত্র। ২০১৪ সালে হিন্দুত্ববাদী শক্তি যখন ভারতে ক্ষমতায় ফিরে আসে তখন তিনি ‘শ্রেণি’ বিষয়ে চলচ্চিত্র বানান, যেটি ছিলো ট্রিলজির প্রথম ছবি। চলচ্চিত্রের সিরিজগুলি এমন একটি সমাজে প্রত্যাশিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যায়, উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করে, যা আধিপত্যের শিকলগুলিকে সম্ভাব্যভাবে সক্ষম বা নিরপেক্ষ করতে পারে। আসলে কে আধিপত্য করে? কে সুবিধা দেয়? ঐক্যমত কে সৃষ্টি করে? এবং কিভাবে এটা টেকসই হয়? ট্রিলজির প্রথম চলচ্চিত্র যা ২০১৬ সালে তৈরি হয়েছিল তা ছিল ডলার সিটি যা তামিলনাড়ুর তিরুপুরের পোশাক শিল্পের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে যেখানে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক হাজার হাজার হোসিয়ারি ইউনিটে পরিশ্রম করে যা ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার দূরবর্তী বাজারের জন্য রপ্তানি সামগ্রী তৈরি করে। ধারণাটি নিপীড়ক এবং নিপীড়িত ঘটনাবলীর বাইরে বৃহত্তর পটভূমিতে নিয়ে যায় যা ঐক্যমতের ধারণাটিকে সমস্যা কীর্ন দেখায় ।

বর্তমান ছবিটির লক্ষ্য হলো কাস্ট বা জাতপাতের ধারণার দ্বারা কিভাবে হেজিমনি তৈরি। পরিচালক জানান যে কাস্ট বলতে আমরা দলিত হরিজন প্রভৃতি নিপীড়িত জাতির কথাই ভাবি। কিন্তু উচ্চবর্ণের মানুষকি জাতপাতের ধারণার বাইরে ? তাঁদের অভিজ্ঞতা কি ? এই ছবিতে সেইসব অভিজ্ঞতার কথা উঠে এসেছে।

পরিচালক অমুধন আরপি, মাদুরাই কামরাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডেভেলপমেন্ট কমিউনিকেশনে স্নাতকোত্তর, চেন্নাই এর একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা, কিউরেটর এবং ফেস্টিভ্যাল প্রোগ্রামার। তিনি ১৯৯৬ সালে তার বন্ধুদের সাথে মাদুরাইতে একটি মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপ – মারুপাক্কম প্রতিষ্ঠা করেছেন ,ডকুমেন্টারি তৈরি করেছেন এবং ডকুমেন্টারির উপর কর্মশালার আয়োজন করেছেন। তিনি মাদুরাই এবং চেন্নাইতে বার্ষিক চলচ্চিত্র উৎসব প্রতিষ্ঠা ও আয়োজন করেন। তার চলচ্চিত্রগুলি জাতি এবং শ্রম সমস্যাগুলিকে নির্দয়ভাবে তুলে ধরে। তিনি এ পর্যন্ত ২০টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন এবং তাদের বেশিরভাগই ক্রাউড ফান্ডেড।

পর্ব ৬ –
‘লংগেন ফোক টু গো অন পিলগ্রিমেজ’ পূর্ণদৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্রটি তৈরি করা হয়েছে উত্তরভারতের কাঁওয়ার যাত্রা বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে। শিবের উদ্দেশ্যে এই যাত্রা হয় প্রতি বছর, শিবের ভক্তগন, যারা কাঁওয়ারিয়া নামে পরিচিত, তারা গঙ্গা নদী থেকে জল ভরে নিজেদের শহরে নিয়ে যায়। ফিল্মটি কেবল যাত্রার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দিকগুলিই নয় বরং এর আর্থ-সামাজিক প্রভাব, এর সঙ্গে যুক্ত পরিবেশগত সমস্যাগুলি (গঙ্গা রাজ্য সহ, যার জল তীর্থযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ) এমনকি এর পুরুষতান্ত্রিক দিকটিকেও তুলে ধরে। চলচ্চিত্রটি এই সামগ্রিক কর্মকান্ড যা সংখ্যা গুরুদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং এর পিছনের রাজনীতিকেও দেখিয়েছে।

বিষয়টিকে একক-কাহিনী হিসেবে দেখা যদিও অনুচিত তবুও কাঁওয়ারিয়াদের নাম তাদের অন্য কোনোভাবে দেখাকে অসম্ভব করে তুলেছে। ধর্মপ্রাণ তীর্থযাত্রীদের হিসাবেই শুধু নয়, বরং অত্যন্ত বিতর্কিত, আক্রমণাত্মক এবং অস্থির জায়গা হিসাবে ব্যক্তিক্রম একটি বিষয়কে তুলে ধরেছে। গোটা ঘটনাটিকে ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত হিন্দুত্ববাদ তার হাত শক্ত করছে এই ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে, এবং ক্রমাগত সঙ্গে উগ্র জাতীয়তাবাদী ভারতীয়ত্বকে একাত্ম করে দেখাচ্ছে।

যদিও এই তথ্যচিত্র কোনোভাবেই এঁদের ভক্তিকে অস্বীকার করেনি, কাঁওয়ারিয়াদের নম্র, দৈনন্দিন জীবন সংগ্রাম থেকে কিছুদিনের জন্য মুক্তিকে দেখিয়েছে। কোনও ভাবেই ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে তাঁদের দ্বিধা হয়নি, কারণ সারা জীবন শ্রম (শিল্প-অসংগঠিত-কৃষি) করেও যখন জীবনে কোনও পরিচিতি মেলে না, তখন শুধুমাত্র এই যাত্রাই তাঁদের কিছুদিনের জন্য অন্যদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু করে তোলে।

সম্ভবতঃ প্রাক কৃষিজীবী সমাজে যখন শিকার ও সংগ্রহে মানুষের জীবন চলতো, তখনকার যুগের কোনও ধর্মীয় প্রথা শিবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই যাত্রার সূচনা করে কারণ ভরা বর্ষায় কৃষিকাজ ছেড়ে এই যাত্রায় যাওয়া কোনও কৃষিজীবী সমাজের ঐতিহ্য হতে পারে না। যদিও এ ব্যাপারে অনেক চিহ্ন ছবিতে আছে, কিন্তু লোককথা ব্যতিরেকে এই যাত্রার কোনো উৎস এই ডকুমেন্টারি ছবিতে দেখানো হয়নি।

পরিচালক কুনাল ভোরা একজন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা যিনি পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন, ই-বর্জ্য, মানব পাচার, এইডস, পশুর অধিকার, শিশু ক্যান্সার, টিবি, ধূমপান ইত্যাদি বিষয় নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন। পরিবেশগত একটি কেসে এঁর তৈরি চলচ্চিত্র সুপ্রিম কোর্টে রায়দানের অঙ্গ ছিলো।

লেখা – ভাস্কর মজুমদার, সব্যসাচী মুখার্জী, সুমিত গাঙ্গুলী
ছবি – সায়ন হাজরা, নিবেদিতা পাঠক

কলকাতা পিপলস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল
৩১ মার্চ – ৩ এপ্রিল ২০২২
উত্তম মঞ্চ (হাজরা)
প্রবেশ অবাধ