ফ্রেমিং ইনোসেন্টস – একটি প্রতিবেদন

১৪ই জুলাই, কলকাতা। নিজস্ব প্রতিবেদক।
স্বৈরাচারী শাসক ও তার অনুগামীরা প্রতিরোধের শিল্পকে ভয় পায়। সেগুলো ধ্বংস করে দিতে চায়। ইতিহাস তার সাক্ষী, বর্তমান তার সবুদ। হয়তো তার কারণ, স্বৈরাচারী ক্ষমতার বিরোধিতায় যাবতীয় আর্টফর্ম ও কলম মৃতপ্রায় বিবেকদের দংশাতে পারে। তাই সর্বশক্তি প্রয়োগে এসবকে থামিয়ে দেবার প্রাতিষ্ঠানিক চেষ্টা চলতে থাকে। গত ন’তারিখ পিপল্‌স ফিল্ম কালেকটিভের ‘ফ্রেমিং ইনোসেন্স’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে কে পি জয়শঙ্কর ও অঞ্জলি মন্টেরো-র ‘ফারুক ভার্সেস দ্য স্টেট’, নীতিন নীরা চন্দ্র-র ‘দ্য সাসপেক্ট’, কে পি শশী-র ‘ফ্যাব্রিকেটেড’ এই তিনটি সিনেমা দেখানো হয়। ‘সাসপেক্ট’ ছবির পরিচালক নীতিন ছবির শেষে আলোচনার জন্য উপস্থিত ছিলেন। অধ্যাপক-সাংবাদিক মহম্মদ রিয়াজ তাঁর বক্তব্যে সারা দেশে সংখ্যালঘু, দলিত ও আদিবাসী সমাজের মানুষ কীভাবে নানান সামাজিক প্রতিক্রিয়াশীল ধারণার ফলে জেলে কাটাচ্ছেন, কীভাবে ৯/১১ পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী ইসলামোফোবিয়ার ফলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন আপাত-‘নিরপেক্ষ’ মুখও প্রভাবিত হয় তা নিয়ে বলেন। বলেন সংঘ পরিবার ও তাদের প্রভাবিত রাজ্যে বিচারের নামে প্রহসনের কথা।
নীতিন নীরা চন্দ্র-র মৈথিলী ভাষার ‘দ্য সাসপেক্ট’ দিয়ে ছবিগুলির আলোচনা শুরু করা যেতে পারে। এই সিনেমাটি “দারভাঙ্গা মডিউল” নামক সন্ত্রাসবাদী ট্যাগ লাগিয়ে বিহারের দারভাঙ্গা অঞ্চলের একটি চিত্র তুলে ধরে। প্রসঙ্গত এই ছবিটি বড়পর্দায় দেখার জন্য কলকাতাবাসী মৈথিলীভাষী বহু মানুষ ওই দিন জড়ো হয়েছিলেন হলে। ফলে ধর্মীর বিভাজনের রাজনীতির পাশে পাশে আলোচনায় উঠে আসে মৈথিলীর মত ভাষার ওপর হিন্দীর টুঁটিচেপা আধিপত্যের প্রসঙ্গটিও। কাজের জন্য বড় শহরে, অন্য রাজ্যে পাড়ি দেওয়া খুব পরিচিত একটি মানুষের মুখ নিয়ে এই সিনেমাটি। নতুন শহরে কাজ খুঁজতে এসে ২৬ বছরের আব্দুল রহিম আনসারি নিজের অজান্তেই তার চেহারা, দাড়ি, পোশাক, ফেজ টুপি, গলার তাবিজের কারণে হয়ে ওঠেন সন্দেহভাজন সন্ত্রাসবাদী। উক্ত দিনে শহরে কয়েকটি ব্লাস্টের সময় কাকতালীয় ভাবে ঐ অঞ্চলে তার নিরপরাধ উপস্থিতি নির্ধারণ করে দেয় যে সেই সন্দেহভাজন ও সন্ত্রাসবাদী। ছেলেটি অকারণে বিপন্নতাবোধ করে, আর ধর্মীয় পরিচিতি পোশাক, দাড়ি, তাবিজ সবকিছু ত্যাগ করে ফেলে বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। আসল অপরাধী বাইরে থেকে যায়। আর শহরের কাছে ছেলেটি শুধু সন্দেহভাজনই হয় না, টেলিভিশনের মিডিয়া ট্রায়ালে জনসমক্ষে তাকে সন্ত্রাসবাদী বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। নীতিন নীরার এই ‘সাসপেক্টের’ সাথে এদেশে সংখ্যাগুরুর চেতনা কতটুকু একাত্ম হতে পারে; এটা গভীর প্রশ্ন হয়েই থেকে যাক। যখন আজকে সংখ্যাগুরুর হিন্দুস্থানে প্রতিটা মায়ের সন্তানের জীবনের মূল্য, অধিকার এক নয়; তাঁদের জন্য এক কানুন নয়। প্রশাসনের নজরদারি, বা শৃঙ্খলও যাদের জন্য এক নয়। একথা পরিষ্কার, ধর্মীয় মেরুকরণের বর্তমান রাজনীতির বাজারে জন্ম পরিচয়ে একই সাথে তিনটে মায়ের (গর্ভধারিণী, গোমাতা, ভারতমাতা) স্বীকৃতি যাদের আছে হয়তো তাদের মানবাধিকার এই দেশে হয়তো একটু বেশী। বাকিরা জন্মগত পরিচয়ের কারণে সারা জীবন সন্দেহভাজনের তালিকা থেকে নাম মুছতে পারে না। এ দেশে ধর্ম-পরিচয়, সত্তা লুকিয়ে রাখার অদ্ভুত প্রয়াসে কখনো কখনো যে আত্ম-সংকট তৈরি হয়ে সেটা নিয়ে কথা না বললেও কিছু যায় আসে না। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর দেশের রাজনীতির যে গতিবিধি, সেখানে মুসলমান ধর্ম পরিচয়ের সাথে ‘সাসপেক্ট’-এর তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। কেউ গারদে থাকবে বিনা বিচারে, কেউ এনকাউন্টারে মরবে, তা না হলে সপ্তাহে দুটো-চারটে করে গণপিটুনিতে; এটাই বাস্তব সত্য। সংখ্যাগুরুর চেতনাতে রোপণ করা হবে ‘সব শালা সন্ত্রাসবাদী, চর, পাকিস্তানের সাপোর্টার’। মুসলমানদের মানুষ বলে ক’টা লোক ভাবে বর্তমান এই দেশে…বিশেষ করে ‘অনির্বচনীয় হুন্ডি’ যাদের হাতে? আব্দুল রহিম বা ফারুকদের কি মানুষ ভাবা যায়? যদি মানুষ হয় তবে তাঁদের বিনা অপরাধে হাজতে পচানো, এনকাউন্টারে খেয়ালখুশি মতো খুন করার অমানবিক ঘটনাগুলো কেন ঘটতে থাকে?
কে পি জয়শঙ্কর ও অঞ্জলি মন্টেরো-র স্বল্পদৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র ‘ফারুক ভার্সেস দ্য স্টেট’ এই প্রশ্ন নিয়ে শুরু হয়। বোম্বের হরি মসজিদে থাকা নিরস্ত্র ফারুকদের উপর পুলিশের গুলি চালনা; আবার তাদেরই বিরুদ্ধে দাঙ্গাকারী অভিযোগের ভিত্তিতে ১৫ জেলে রাখার পর, আদালত যখন তাকে বেকসুর খালাস করে, তখন সে আদালতে আবেদন করে দীর্ঘ বছরগুলো তাকে কি ভাবে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে? এই আবেদন শুধু কি ফারুকরা করেছিলেন? ৯ তারিখের অনুষ্ঠানে বিতরণ করা লিফলেট বলছে অতি সম্প্রতি এই আবেদন করেছিলেন মৃত্যুদন্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত এবং ১২ বছর পর বেকসুর খালাস হওয়া অক্ষরধাম ব্লাস্টের ভুঁয়ো-অভিযুক্ত যুবকরাও। আদালতে এই প্রশ্নের উত্তরে তাঁদের বলা হয় যদি তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, তবে পরবর্তী সময়ে খারাপ ফলাফল দেখা দেবে। সে যাক, তথ্যচিত্রে ফারুক আইনি পদ্ধতিতে লড়াই চালায় স্টেটের বিরুদ্ধে। ছবিটি দেখতে দেখতে আমার জানতে ইচ্ছে হয়েছিল খুব ফারুকের কি ভোটার কার্ড আছে? ফারুক ভোট দেয়? ফারুক কি আধার কার্ডটা করিয়েছে? আচ্ছা নির্দোষ ফারুকদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার যে সনদটা আমাদের দেশে আছে, সেটার এক কপি যদি পাওয়া যায়, তবে কি কিছুটা বুঝতে সহায়ক হত? সনদের দরকার নেই, তথ্য দেখুন। প্রতিবছর যখন এই দেশ স্বাধীনতা উদ্‌যাপিত হচ্ছে মহাসমারোহে, সেখানে হাজার হাজার নির্দোষ বন্দী বিচারহীন অবস্থায় ভারতীয় জেলে রয়েছেন। এই ব্যবস্থা বহাল রাখার জন্য জাতীয় নিরাপত্তার নামে রয়েছে বেশ কিছু দানবীয় আইন। ফলে তাঁরা বিচার শুরু হওয়ার জন্য অপেক্ষা করবেন বছরের পর বছর ধরে।
আবদুল নাসের মাদানির কথা শুনেছেন কি? কেরালার একজন মুসলিম ধর্মীয় নেতা। তিনি ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের বিরুদ্ধে প্রচুর মানুষকে সমাবেশিত করে দৃঢ়ভাবে প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি মূলতঃ দক্ষিণ ভারতের দু’তিনটি রাজ্য জুড়ে দলিত-মুসলিম শ্রমজীবি মানুষের ঐক্যের লক্ষ্যে হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলির বিরুদ্ধে বিপুল জনসমাবেশ ও সংগঠন গঠনের পথে এগোচ্ছিলেন। তাঁর বাড়িতে আক্রমণ করা হয় এবং তাঁকেই সাড়ে নয় বছর হাজতে থাকতে হয়। তাঁর বিরুদ্ধে সব অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয় এবং এমনকি রায়ও স্পষ্ট করে তোলে যে মামলাগুলো মিথ্যা সাজানো ছিল। তিনিও ফারুকের মতোই কোনো ক্ষতিপূরণ ছাড়া মুক্তি পান। তাঁর ওপর শারীরিক হামলা হয়। হামলায় তাঁর পা দুখানি কাটা পড়ে। অল্পের জন্য বুলেট ফস্কে প্রাণে বেঁচে যান। এই ধরনের হামলা ও মামলার জালিয়াতির জন্য যারা দায়ী ছিল তাদের উপর শাস্তি দেওয়ার বদলে মাদানির উপরেই ফের চাপানো হয় আরও গুচ্ছ গুচ্ছ কেসের ফাইল। আবার ঢুকিয়ে দেওয়া হয় জেলের অন্দরে। যা এখনো বিচারাধীন। তাঁর বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে তৈরি ডকুমেন্টারি ‘ফ্যাব্রিকেটেড’ আরও অনেকগুলি বিন্দু জুড়ে জুড়ে দেখায় যে এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। যেমন, মাদানির বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে সাংবাদিক কে. শাহিনা যখন তথ্যসন্ধান করে নিউজ রিপোর্ট বের করতে শুরু করেন এবং মিথ্যে সাক্ষীদের এঁকে এঁকে উন্মোচিত করতে থাকেন তখন শাহিনা-র ওপর পর্যন্ত চাপানো হয় একের পর এক মিথ্যে মামলা। পাঠানো হয় জেলে! প্রান্তিক মানুষদের আন্দোলন, প্রতিরোধ দমনে রাষ্ট্রীয় পেশী ক্ষমতায় হিন্দু-হিন্দুস্থানি কানুন কখন কীভাবে এক হয়ে কাজ করে; এর দৃষ্টান্ত হিসাবে বেশ কয়েকজন মুসলমান, দলিত, আদিবাসী নেতৃত্ববর্গের কাছ থেকে একইরকম অভিজ্ঞতার কথা উঠে আসতে দেখা যায়। ছবিতে উত্থাপিত প্রশ্নটি হল, কেন একজন ব্যক্তি অপরাধী প্রমাণিত না হওয়াতেও এত বছর ধরে কারাগারে কাটিয়েছেন? তাঁর ওই বছরগুলো কে, কীভাবে ফিরিয়ে দেবে?
এই প্রশ্নের অনুরণন আজও বিভিন্ন প্রান্তে গুঞ্জরিত হয়। মহম্মদ রিয়াজের বক্তব্যে যেমন উঠে আসে ২৮ বছর বয়সে সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে ১৬ বছর কারাগারে বন্দী থাকা কাশ্মীরি পিএইচডি ছাত্র গুলজার আহমেদ ওয়ানির কথা। সুপ্রিমকোর্ট তাকে নিরপরাধ আখ্যা দিলেও মেধাবী ছেলেটির ১৬ বছরের ক্ষতিপূরণ নিয়ে কোন আইন বা আদালত সাহায্য করেনি। এই ছবিগুলি আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো নিয়ে মৌলিক স্তরে প্রশ্ন তোলে। বর্তমানে এই ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্য দিয়ে কীভাবে মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়; অসংখ্য নিরপরাধ মানুষদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে কীভাবে একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক আবহ তৈরি করা হয়। যেখানে নির্দোষ ফারুক, গুলজার, আব্দুল, মাদানিরা ভিক্টিম হয়েও সাসপেক্ট হয়ে ওঠেন ধর্মীয় পরিচয়গত কারণে। এই অশান্ত সময়ে দাগিয়ে দেওয়ার যে রাজনীতি চলছে; সেখানে নিরপরাধ জেলবন্দীর ৬৫ শতাংশ মুসলমান, দলিত, আদিবাসীবর্গের মানুষ। তাদের মানবাধিকারের উল্লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে চীৎকারগুলো কতদূর আর কতটুকু প্রভাব বিস্তার করবে জানা নেই। যখন এ রাজ্যের একবর্গের গো-সন্তানেরা গো-বুদ্ধির দৌলতে শুধু এটুকুই বোঝেন যে সন্ত্রাসবাদী মানেই মুসলমান, বোঝেন জঙ্গলে যারা এতটুকু প্রতিরোধ করে তারাই মাওবাদী, আর বোঝেন তফশিলি জাতি, উপজাতি ও অন্যান্য পিছিয়ে থাকা বর্গের মানুষরা চাকরী খেয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে উচ্চবিত্ত উচ্চবর্ণের জায়গাগুলো দখল করছে। আবার এহেন গো-মস্তিষ্কের পরিচালকেরা পাড়ায় পাড়ায় ক্লাস নিয়ে পরিকল্পিত ‘ফ্যাব্রিকেটেড’ উপায়ে দলিত-পিছড়েবর্গের মানুষদেরকেই ধর্মের নামে সেপাই গড়ে তুলে ঠেলে দিচ্ছেন দাঙ্গা ও মৃত্যুর মুখে। বিজেপির হিন্দু সংঘগুলোর এই কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার রাজনীতি অর্থাৎ মুসলমানদের প্রতি দলিত হিন্দুদের খেপিয়ে তুলে দুই পক্ষের মানুষেরই শবদেহের উপর উচ্চবর্গের গেরুয়া পতাকা ওড়ানোর প্রচেষ্টা যেমন শুরু হয়েছে। তেমনই, আশার কথা, ধর্মের আর জাতিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে শ্রেণীশোষণ, অনুন্নয়ন, মানবাধিকার, বাজারের একাধিপত্য, বেকারত্ব, শোষণকারী কর-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সম্মিলিত লড়াইগুলো বিভিন্ন দিক থেকে সোচ্চার হতে শুরু করেছে। মগজ বেদখলের বিরুদ্ধে শাণিত লড়াই জারি থাকুক। সিনেমা জারি থাকুক।
0 replies

Leave a Reply

Want to join the discussion?
Feel free to contribute!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *