।।ফেস্টিভ্যালের ডায়েরি।দ্বিতীয় দিন-২১ জানুয়ারী।।

,

এবছরের ফেস্টিভ্যালের ৩৯টি ছবির মধ্যে ৯টি দেখানো হল উৎসবের দ্বিতীয় দিনে। এদিনের প্রথম ছবি দক্ষিণ কোরিয়া নিবাসী বাংলাদেশি তথ্যচিত্রনির্মাতা শেখ আল মামুনের ‘নো ওয়ে আউট’। ছবিটি দক্ষিণ কোরিয়ার প্রবাসী শ্রমিকদের অবস্থা নিয়ে তৈরি। মূলতঃ বাংলাদেশ আর নেপাল থেকে আগত প্রবাসী শ্রমিকদের কথোপকথন এবং সাক্ষাৎকার নিয়ে তাদের নানা সমস্যা এবং তাদের টিকে থাকার লড়াইয়ের একটা রূপরেখা আমাদের সামনে হাজির করেন আল মামুন।

দক্ষিণ কোরিয়াতে “এমপ্লয়মেন্ট পারমিট ব্যবস্থা” প্রায় ১৮ বছরের পুরোনো। এই ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর নানা দেশ থেকে বহু মানুষ দক্ষিণ কোরিয়াতে কাজের সুবাদে এসে হাজির হয়। কিন্তু এই পারমিট ব্যবস্থার সবথেকে সমস্যাক্রান্ত দিকটি হলো কাজের জায়গা পরিবর্তনের সুযোগ না থাকা এবং কোনোভাবে কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করা সম্ভব হলেও তা বিরল ও অতিমাত্রায় জটিল। শ্রমিকদের সাথে কথোপকথনে আমরা জানতে পারি যে তিন বছরের জন্যে তাদের শ্রমিক ভিসা দেওয়া হয়। শ্রমিক আইন অনুযায়ী কোন শ্রমিক যদি কাজের জায়গা পরিবর্তন করতে চায় তবে তাকে তার পূর্বতন মালিকের কাছ থেকে লিখিত অনুমতি নিতে হবে। এখানেই হয় মুশকিল। এই লিখিত অনুমতি কেউ দিতে চায় না। মালিকদেরও একটা রেটিং সিস্টেম চালু আছে। সেই রেটিং কমে গেলে পরবর্তীতে তার নতুন শ্রমিক যোগান পেতে সমস্যা হবে। অধিকাংশ প্রবাসী শ্রমিককে কাজ করতে হয় খুবই কঠিন পরিস্থিতিতে। বিশেষ করে যারা এই পারমিট নিয়ে আসে তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকে না। বয়সে নবীন এই শ্রমিকরা প্রতিকূল পরিবেশে এবং নিজের বাড়ি থেকে বহুদূরে এক অচেনা পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে না। তার ফলে প্রথম কাজের ক্ষেত্রে যদি এমন কোন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয় যে তাদের পক্ষে আর কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না, তখন এই অনুমতি পেতে ঝামেলা হয়। শুধু তাই নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের সাথে যে ব্যবহার করা হয় সেটা অমানবিক। তাদের প্রাপ্য পয়সা পর্যন্ত দেওয়া হয় না। মামুন একটি দৃশ্যে দেখান যে একজন শ্রমিক সই করা অনুমতিপত্র চেয়েছে বলে, ম্যানেজার তার সমস্ত জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। শুধু তাই নয় তাকে মারধরও করা হচ্ছে। মুশকিল হলো এর সেরকম কোন প্রতিকারের উপায় থাকে না। দক্ষিণ কোরিয়ার কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও ইউনিয়ন প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে লড়াই করছে। কিন্তু ওখানকার আইনের জটিলতায় তাদেরও অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে খুব কিছু করার থাকে না। তাদের বক্তব্য হল একমাত্র এই আইনের পরিবর্তন হলেই কিছু করা সম্ভব। যদিও সিনেমাটি শুধুমাত্র প্রবাসী শ্রমিকদের সমস্যা নিয়েই। কিন্তু বর্তমানে পুঁজিবাদের বিশ্বায়নের অন্যতম শর্ত কিন্তু এই প্রবাসী শ্রমিক এবং তার নির্মম শোষণ। ঠিক একইভাবে এর দ্বান্দ্বিক ফলাফল হচ্ছে এই প্রবাসী শ্রমিকরাও উন্নত দেশগুলিতে শ্রমিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ছেন। মামুন তার তথ্যচিত্রে এই বিষয়টিরও অবতারণা করেছেন। আশা করি আমাদের বিদগ্ধ দর্শকদের মামুনের তথ্যচিত্রটি শ্রমিক আন্দোলন ও তার দিশা নিয়ে আরো গভীর ভাবে ভাবতে সাহায্য করবে।

পরবর্তী ছবি, দেবশ্রী নাথের ‘নূর ইসলাম’, শুরু হচ্ছে নদীর শান্ত বহমানতায়। যেমন নদী এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বয়ে যায়, মানুষরাও, বা বলা ভালো উদ্বাস্তুরা, তা-ই। রাষ্ট্রনায়কদের খামখেয়ালিপনায় দেশভাগের জ্বালাময়ী যন্ত্রণায় বহু মানুষকে ওপার থেকে এপারে আসতে হয়েছিল, যাদের আমরা এতদিন পড়শিপাড়ার বন্ধু হিসেবেই চিনতাম। ২০১৫-র পর থেকে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী এনআর সি-র আওতায় আসামের উদ্বাস্তুদের নাগরিক তালিকা থেকে উচ্ছেদ নতুন করে শুরু হয়। সেই সময় থেকেই সিএএ-এনআরসি লাগু করার চেষ্টা করতে থাকে কেন্দ্রীয় সরকার। তাই সহজেই অনুমেয় বিচারব্যবস্থা কেমন রাষ্ট্রের অঙ্গুলিহেলনে চলছে। যা হোক, সিনেমায় ফিরে আসি।

শান্ত, সবুজ প্রকৃতির কোলে টিনের চাল দেওয়া ঘর। একেবারেই ঢিমে তালে চলা একটি সিনেমা। দৈনন্দিন কাজকর্ম সারছে মানুষ। গৃহবধূ রান্না করছে, মেয়ে স্কুল যাওয়ার জন্যে তৈরী হচ্ছে। কোনরকম নাটকীয়তা বা আতঙ্ক চোখে পড়ছে না। একটা বাচ্চা মেয়ে অতি কষ্টে নদী পার হয়ে স্কুল যাচ্ছে। শিক্ষা যে কত নগণ্য একটা বিষয় তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আসামের পরিস্থিতির কথা একটি ছেলে তার বাবাকে ফোনে জানাচ্ছে, অথচ তারা বলছে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে। কোর্ট বিচারব্যবস্থা নিয়েও তারা উদাসীন। কোনরকম আশা বা লড়াইয়ের স্বপ্নও যেন তারা হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু তবু ছেলে বলে যে কিছু একটা হবে এমনটা কোর্ট আশ্বাস দিয়েছে। যখন এই দীর্ঘ কথোপকথন চলছে যা নিতান্ত আপাতভাবে সাদামাটা তখন দেখানো হচ্ছে ছেলে ভাত খাচ্ছে, তারপর ছেলে সাইকেল নিয়ে বেরোচ্ছে জামাকাপড় পড়ে, আবার কোনও সময়ে তাদের পরিবারের টুকরো টুকরো স্মৃতির চিত্র। কোনও সময়েই ছেলে কথা বলছে এটি সরাসরি দেখানো হয় না। মেইনস্ট্রিম সিনেমার গ্রামারকে যে শুধু ভাঙা হল তাই নয় বরং দর্শকের কাছে এটাও অনুভব হল যে এই অপমান তাদের কাছে দৈনন্দিন কাজকর্মের মতোই জলভাত, এর বাড়তি কোন উদ্রেক আর নেই। এরপরে একটা লং শট আমরা দেখি যেখানে ছেলেটা কেবল অপেক্ষা, অপেক্ষা আর অপেক্ষাই করছে কবে তারা ভারতীয় নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত হবে। দিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়, সেই দিনের সূর্যাস্ত যেন আর হবে না।

ডিটেনশন সেন্টারে বহু মানুষকে নিরন্তর প্রশ্ন করা হচ্ছে তাদের জন্মস্থান, তাদের বাবার জন্মস্থান নিয়ে, এসব প্রশ্ন যার উত্তর তাদের কাছে নেই। নথি না দিতে পারায় ও উত্তর না দিতে পারায় অসমের মানুষদের নাগাড়ে হেনস্থা হতে হয় এবং তারা তা বিনা প্রতিবাদেই মেনেই নেন। সিনেমার শেষ দৃশ্যে দেখি একটা নৌকা করে বহু মানুষ অন্য কোন জায়গায় যাচ্ছে অন্য কোন এক আশ্রয়ের খোঁজে, একটু শান্তির খোঁজে। সিনেমায় নদী বারবার ফিরে এসেছে। নদী এখানে কেবল স্থান নয় বরং এমন এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র যাদের সাথে এই মানুষদের জীবন মিশে যায়।

দ্বিতীয় দিনের তৃতীয় ছবি ‘সিটি অফ লেনস’ (‘গলিওঁ কা শহর’) এর পরিচালকদ্বয় হলেন মোদক কেএস ও রাগিনী রাও মুঞ্জুলুরি। ৩৯ মিনিটের এই হিন্দি ছবিটি ২০২১ সালে তৈরী হয়। উত্তরপ্রদেশের বেনারসে সাম্প্রতিক কাশী বিশ্বনাথ করিডোর প্রকল্পটিকে শহরের বাসিন্দাদের দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে দেখে ছবিটি৷ ধর্ম ও নাগরিক-রাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা, উন্নয়নের আড়ালে নির্বিচার ধ্বংসলীলা, শহরে বাসস্থানের অধিকার এবং শহরের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পটবদলের ভিত্তিগুলি অন্বেষণ করে বেড়ায় ছবিটি। কাকে আধুনিকতা বলব? একটি প্রাচীন শহরের আধুনিকীকরণ বলতে কী বোঝায়? বর্তমান হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির আবহাওয়ায় এই প্রশ্নগুলির ওপর আলোকপাত করে ছবিটি।

আমরা দেখি ছেনি, হাতুড়ি, শাবল আর বুলডোজারের আঘাতে রাস্তা চওড়া করার নামে বহু বাড়িঘর, দোকান, স্থাপত্য, ছোট বড় পুরাতন মন্দির ধ্বংস করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে এর সঙ্গে যুক্ত প্রোমোটার, ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীরা উৎসাহ দেখালেও ক্রমে সঙ্কট, সন্দেহ ও আতঙ্কের আভাস পাওয়া যায় তাদেরও বক্তব্যে। সম্ভাব্য গৃহহারারা তাদের ভবিষ্যতের অনিশ্চিত জীবন, জীবিকা ও বাসস্থান নিয়ে উদ্বেগ, দীর্ঘদিনের পূর্বপুরুষের আবাসস্থল এমনকি পারিবারিক বিচ্ছেদ ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল হারানোর আশঙ্কায় ক্রমে নিজেদের বিরোধী মনোভাব তুলে ধরে। যদিও বর্তমান শাসকের বিরুদ্ধে কোনোও প্রবল বিরোধীর অস্তিত্ব না থাকাতে তারা পুনরায় এই শাসককেই বেছে নিতে বাধ্য বলে মনে করে।

পরবর্তী ছবি ‘র‍্যাট ট্র্যাপ’-এর পরিচালক রূপেশ কুমার সাহু। ৩৪ মিনিটের সাঁওতালি ও হিন্দি ভাষার ফিল্মটি প্রকাশিত হয় ২০২২ সালে।‍ ‘র‍্যাট ট্র্যাপ’ হল ঝাড়খন্ডের খোলামুখ কয়লাখনি শ্রমিকদের নিয়ে একটি চলচ্চিত্র। জীবিকা অর্জনের জন্য যে শ্রমিকদের নিরন্তর জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়। প্রায় দু দশকের ফুটেজ নিয়ে তৈরি ছবিতে আমরা দেখি যে অনেক দুর্ঘটনা রিপোর্ট করা হয় না, ফলতঃ আমরা বাইরে থেকে জানতেও পারি না। খোলামুখ খনি শ্রমিকদের জীবন এতটাই দুর্বিষহ। খনি ধসে পড়ার সময়, তাদের জন্য কেউ এমনকি চোখের জল ফেলতে পারে না। তাদের প্রিয়জনেরা দেহ দাবি করতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে কয়লার জাতীয়করণ কয়লা কোম্পানিগুলিকে ওপেন কাস্ট মাইনিং-এর দিকে আরও ঠেলে দেয়, কোম্পানিগুলি শ্রমিক নিরাপত্তা ও প্রাকৃতিক দূষণের কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে কয়লা তুলতে থাকে। সেই ইঁদুরকলে পড়ে শ্রমিকের জীবনের দাম কানাকড়িও থাকে না। প্রকৃতি ও মানুষের এই সঙ্কট ছবিটিতে জোরালোভাবে ধরা পড়েছে।

পরবর্তী ছবি, বিক্রম বোলেগাভে নির্দেশিত ‘মহাসত্তা’ (‘সুপারপাওয়ার’) একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র। মহারাষ্ট্রের কোন একটি ছোট গ্রামে রামের ঘর। মূলতঃ কৃষিকাজ করেই জীবন-জীবিকা চলে। কখনও বা সিমেন্ট বালির কাজ জুটে যায়। বাড়িতে বাবা আছেন, আর আছে দাদা বৌদি আর তাদের ছেলে। এই দৈনন্দিনতার মধ্যে তারা খবর শোনে, ভারতবর্ষ আগামীদিনে সুপারপাওয়ার হবে। তার জন্যে সরকারের নানা প্রকল্পের ঘোষণা। তাতে যেমন আশা জাগে, তেমনই পুরোপুরি বিশ্বাস করতেও মন চায় না। এই গড়পরতা জীবনে হঠাৎ একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায় রামের জীবনে। ঘরেই তার দাদাকে সাপে কামড়ায়। রাম একটা অটো জোগাড় করে দাদাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও তাকে বাঁচানো যায় না। হাসপাতাল, তার ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ডাক্তারের অভাব, এগুলো সবই একভাবে এই মৃত্যুর কারণ। যে অটো করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তার মাঝে মাঝে থেমে যাওয়ার দৃশ্যায়ন এই ব্যবস্থাপনার এক বাস্তব উপস্থাপনা। এরকম ঘটনা এই ধরনের গ্রামের মানুষদের কাছে খুবই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক হলো এই সুপারপাওয়ার হওয়ার দাবী করা। বিক্রম এই ভন্ডামিকে সুন্দর প্রকাশ করেছেন তার এই গল্প বলার মাধ্যে দিয়ে। সিনেমাটোগ্রাফি খুবই প্রশংসনীয়। আর অভিনয় অনবদ্য। ছবিটি প্রদর্শনের সময়ে প্রেক্ষাগৃহ প্রায় ভর্তি ছিল।

দ্বিতীয় দিন দুপুরের ব্রেকের পরের ছবি বাংলাদেশের পরিচালক মাসুদ সুমনের ‘ধূসরযাত্রা’। এই সিনেমার মূল চরিত্র শোভন মৃত মানুষের লাশ গোসল করে দাফন করার আগে। একটা ভাঙা ঘরে তার বসবাস। তার বউ মারা গেছে বহুদিন হলো। কিন্তু স্মৃতি তাকে ছেড়ে যায় নি। তাই একটা পুতুলের সাথে তার বসবাস এবং কথোপকথন। শোভনের যাপন যেন মৃত্যুর অপেক্ষা। এরই মাঝে সে আশপাশের ঘটনা দেখে আর ভাবনাগুলোকে পুতুলের সাথে আদানপ্রদান করে। তবে তার এই পরাবাস্তব অস্তিত্বকে শেষপর্যন্ত সরিয়ে রেখে তাকে পা দিতে হয় বাস্তবের মাটিতে। ইমাম সাহেব জানান তাকে তাদের মসজিদের সেক্রেটারি ডেকে পাঠিয়েছেন। সময়টা কোভিড অতিমারীর। ব্যবসা পত্র বন্ধ। মানুষ ঘরের বাইরে বেরতে পারছে না। ছবিতে একজন যৌনকর্মীর পরিস্থিতি দিয়ে পরিচালক অতিমারীর সময়কার মানুষের অসহায়ত্বকে অসাধারণ ভাবে উপস্থিত করেছেন। শোভন কোভিডে মৃতদের দেহের গোসল করানোর কাজে জুড়ে যায়। এই কাজ করার সময় সেও কোভিডে আক্রান্ত হয় এবং মারা যায়। ইমাম সাহেবের জবানীতে আমরা জানতে পারি যে কোনও এক সংক্রামক রোগে শোভনের স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে দাফন করানোর আগে গোসল করানোর জন্যে কাউকে পাওয়া যায় নি। শোভনের লাশ গোসল করানোর কাজে যুক্ত হওয়ার কারণ এটাই। কোনভাবেই সে পয়সার জন্যে এই কাজে যুক্ত হয় নি। ছবিতে নাটকীয়তার প্রভাব থাকলেও বিষয়বস্তুর নতুনত্ব অবশ্যই দর্শকদের কাছে অতিমারীর সময়ের এক মর্মস্পর্শী কাহিনী হাজির করাতে পেরেছে।

মাসুদ সুমনের সাথে ‘ধূসরযাত্রা’ নিয়ে কথোপকথনের পর, শুরু হয় এহরাজ আসমাদুজ জামানের ছবি ‘ইন এ ডিসেন্ট ম্যানার’। ১৫ই ডিসেম্বর ২০১৯-এর রাতের অন্ধকারে আলিগর মুসলিম ইউনিভার্সিটি চত্বরে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ ঢুকে পড়ে। সেইসময় দেশ জুড়ে এনআরসি-সিএএ-র বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছিল। আর জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়াতে দিল্লি পুলিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছিল। তারপর যা হয় সেটা সম্ভবত স্বাধীন ভারতে নকশাল আন্দোলনের পর ছাত্রদের উপর সবথেকে বর্বর পুলিশি আক্রমণ। এহরাজ-এর তথ্যচিত্র সেই ঘৃণ্য এবং লজ্জাকর ঘটনাক্রমের একটা প্রামাণ্য দলিল। বিভিন্ন স্টক শট, প্রত্যক্ষদর্শীদের তোলা ফুটেজ আর সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে আমরা পৌঁছে যাই সেই সময়টাতে, আর প্রত্যক্ষ করতে থাকি একদিকে ছাত্রদের ওপর রাষ্ট্রীয় আক্রমণের বহিঃপ্রকাশ, আরেকদিকে ছাত্রদের অসহায়তা। প্রায় এক ঘন্টার উপর বিভিন্ন সাক্ষাৎকার, বিশেষ করে যেসব ছাত্ররা প্রত্যক্ষভাবে মার খেয়েছে এবং আহত হয়েছে তাদের বয়ানে আমাদের সামনে ধীরে ধীরে একটা ফিকে-হতে-থাকা স্মৃতি আবার তার দগদগে ঘা নিয়ে উপস্থিত হয়। একদিকে সরকারের ছাত্রদের প্রতি, বিশেষ করে মুসলিম ছাত্রদের প্রতি, নির্মম দৃষ্টিভঙ্গী, আরেকদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ দেখানোর মধ্যে দিয়ে অনাগত ভবিষ্যত সম্পর্কে এহরাজ আমাদের সতর্ক করে দেন, যার সাথে একমাত্র জ্যাক লন্ডন বর্ণিত ‘আয়রন হিল’এরই তুলনা চলে। ছবিটি শেষ হওয়ার বহুক্ষণ পরেও দর্শকদের মধ্যে ছবিটি নিয়ে গুঞ্জন চলতে শোনা যায়। অনেকে আগামীদিনে কলেজ ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে ছবিটি দেখানোর বন্দোবস্তের কথা জানতে চান।

এদিনের পরবর্তী ছবি, ভারতের শ্রেয়স দশরথে ও পাকিস্তানের জামশেদ ইরানির যৌথ নির্দেশনায় তৈরি ছবি ‘ভাইরাল’। মুম্বাইয়ের শাইনি, বান্দু ও করাচির হাম্মাদের কাহিনি। শাইনি এবং বান্দু দুই ভাই হল হাম্মাদের অন্ধ ভক্ত, যে হাম্মাদ করাচির একজন ডিম-বিক্রেতা, যার মুম্বাই শহরে একটি বিশাল অনলাইন ফলোয়ার বাহিনী রয়েছে কিন্তু নিজের আশেপাশের এলাকায় কার্যত সে অচেনা। হাম্মাদ মাঝে মাঝে সামাজিক গণমাধ্যমে রিল বানিয়ে ভাইরাল ভিডিও বানায়। যা শাইনি এবং বান্দু মুম্বাইয়ে বসে বসে দেখে। আরব সাগরের দুই পারে সংযোগ তৈরি হয়। তারা অনলাইনে সংযোগ স্থাপন করে এবং এর পরেই শুরু হয় বন্ধুত্বের দিকে এক আন্তরিক যাত্রা। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা তাদের ঘিরে ফেলে কিন্তু তারপরও তারা তাদের স্বপ্নিল কাল্পনিক জগৎকে ঘিরে এগিয়ে চলে। একদিন করাচির হাম্মাদ, তার পাড়ার একটি কিশোরের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে মারাঠি গানে অভূতপূর্ব নাচে, আর বান্দু ও শাইনি হাম্মাদের থেকে শেখা উর্দু শায়েরি ফুটিয়ে তুলে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে যায়, তারা নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল খোলে। এভাবে দেশ কাল ধর্ম ও ভাষার ভেদ ঘুচিয়ে দেয় শিল্প। প্রান্তিক শ্রমজীবীর নিজস্ব অভিব্যক্তির শিল্প। অবশ্য নয়া উদারবাদী দুনিয়ায় ট্রান্স-ন্যাশনাল পুঁজিবাদ জনগণের শিল্পকে ব্যবহার করে নতুন ক্রনি-ক্যাপিটালের বাজার তৈরি করছে, এমনটাও ঘুরিয়ে ভাবা যেতে পারে।

এদিন সন্ধেবেলা ফেস্টিভ্যালের কীনোট বক্তৃতায় আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সমাজকর্মী তিস্তা শেতলবাদ। ২০০২ সালের গুজরাত গণহত্যার পর, গুলবার্গ সোসাইটিতে হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাকারীদের হাতে বহু মানুষের গণহত্যার বিষয়টি নিয়ে যখন নিহত জনপ্রতিনিধি এহসান জাফরির স্ত্রী জাকিয়া জাফরি সুপ্রীম কোর্টে মামলা করেন, তখন তিস্তা শেতলবাদ তার সহ-মামলাকারী ছিলেন। তাদের মামলায় তারা তৎকালীন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সহ পুলিশ ও প্রশাসনের একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তিকে এই গণহত্যা ঘটতে দেওয়ার অপরাধে অভিযুক্ত করেন। কিন্তু ভারতবর্ষে কবে আর কোন গণহত্যার শাস্তি কেউ পেয়েছে! অতএব ‘নয়া ভারতের’ রীতি অনুযায়ী দুজাহার নিরপরাধ মুসলমানের গণহত্যার অপরাধের পরও একের পরে এক প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ একে একে বেকসুর খালাস বা জামিন পেয়ে যান। গত জুন মাসে নরেন্দ্র মোদীকে বেকসুর খালাস ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট, সাথে সাথে হুমকি দেয় জাকিয়া জাফরি মামলার ভুক্তভোগী ও মামলাকারীদেরকেই। এ সত্যি এক ‘নয়া ভারত’ বটে! যেখানে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া ও নিহত ব্যক্তির পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর অপরাধেই প্রকারান্তরে জেল খাটতে হয় তিস্তা শেতলবাদকে। বর্তমানে তিনি জামিনে মুক্ত, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে মামলা চলছে। ‘আজকের ভারতে ন্যায়বিচারের সন্ধানে’ শীর্ষক বক্তৃতায় তিনি আজকের ভারতের প্রধান বৈষম্যগুলি ও মৌলিক সমস্যাগুলিকে একে একে চিহ্নিত করেন। সংসদকে ব্যবহার করে ফ্যাসিস্টরা কীভাবে সাংবিধানিক মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচারে সব রাস্তাগুলিকে কীভাবে গলা টিপে হত্যা করেছে একের পর এক উদাহরণ দিয়ে সেই বিষয়গুলিকে জোরালো ও প্রাঞ্জলভাবে দর্শকের সামনে তুলে ধরেন। যার রেশ চলে প্রশ্নোত্তর পর্ব জুড়েও।

তিস্তা শেতলবাদের বক্তৃতার পরে, কিশলয় নির্দেশিত ‘অ্যায়সে হী’ ছবিটি ছিল আজকের শেষ ছবি। এই সিনেমাটির মূল বিষয় ভারতবর্ষের মধ্যে উত্তরপ্রদেশের একটি শহর এলাহাবাদ এবং সেখানে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে পিতৃতান্ত্রিকতার দৈনন্দিন প্রকাশ। ছবিটিতে একটি পরিবারকে দেখনো হয়েছে যারা শর্মা, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ। সেকারণে ওই অঞ্চলে তারা বেশ সম্মানীয়। পরিবারটিতে মিসেস শর্মার স্বামী গত হয়েছেন। তার এক ছেলে এবং এক মেয়ে। মেয়ে বাইরে থাকে, বিবাহিতা। ছেলে, ছেলের বউ এবং তার দুই নাতি নাতনি তার কাছে থাকে। দোতলা বাড়ি, ছেলে নীচের তলায় থাকেন। আর মিসেস শর্মা উপর তলায় একাই থাকেন। নাতি আর নাতনি উভয়েই স্কুলে পড়ে। নাতনি বড় আর নাতি ছোট। এহেন একটি পরিবারে কিশলয় ক্যামেরা নিয়ে ঢুকে পরেন একেবারে অন্দরমহলে। মিস্টার শর্মা মারা যাবার পর শ্রাদ্ধ শান্তির জন্যে যখন বাড়িতে সবাই জমায়েত হয়েছেন তখন মিসেস শর্মা আশ্রয় নেন বাথরুমে। ক্যামেরা ওঁকে ফলো করে বাথরুমে উপস্থিত হয়। বাথরুমের ভেতর মিসেস শর্মার কার্যকলাপে দর্শক টের পান যে ওঁকে কোনভাবেই বাড়ির অন্য সদস্যদের সাথে মেলানো যাচ্ছে না। আমাদের দেশের পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিবারে বাবার অবর্তমানে মা থাকেন ছেলের অধীনে। একমাত্র তখনই একজন বিধবা মা বাড়ির সর্বময় কর্তা হয়ে ওঠেন যখন তিনি সর্বতোভাবে পিতৃতন্ত্রকে ধারণ করার শর্ত মেনে নেন। এই শর্তের মূল উপাদান হল বাড়ির অন্যান্য মহিলা সদস্যদের পিতৃতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে রাখা। কিন্তু মিসেস শর্মা এসব কিছুই করলেন না। উল্টো দিকে তিনি কোন বিদ্রোহও করলেন না। শুধু যে বাড়িটিতে তার স্বামীর অবর্তমানে তার থাকার অধিকার সমাজে এবং আইনত স্বীকৃত সেখানে তিনি তার নিজস্ব একটি জগত গড়ে তোলার চেষ্টা করলেন। তার অবসর খুঁজে নেওয়া, অবসর তৈরি করা, আকাশ দেখা, নদীর পারে বসে আনমনে তাকিয়ে থাকা, নদীর কুলকুল শব্দ শোনা, এসবই তার ভাল লাগা। তার এই ভাললাগাকে যা হয়তো মিস্টার শর্মা বেঁচে থাকাকালীন কখনও পূরণ হয় নি, তা তিনি নতুন করে পাবার চেষ্টায় ছিলেন। পুরনো জিনিস ঘাটতে ঘাটতে তিনি এম্ব্রয়ডারির একটা ড্রয়িং খুঁজে পান। একজন মুসলিম দর্জির সাথে তিনি যোগাযোগ করেন এমব্রয়ডারি শিখবেন বলে। তার সাথে একটা সখ্যতা গড়ে ওঠে। আস্তে আস্তে কাজ শিখে নিতে থাকেন এবং তার সাথে কিছু অর্ডারের কাজও শুরু করেন। এইভাবে আস্তে আস্তে মিসেস শর্মার বাইরের জীবন গড়ে উঠতে থাকে। শর্মাদের খাওয়ার টেবিলের কথোপকথন এই সিনেমার এক মূল আকর্ষণ। সেখানে অন্তর্লীন পিতৃতান্ত্রিকতা খুব সুন্দর প্রকাশ পায়। বাচ্চাদের মাকে নিয়ে মজা করা, এবং তাতে বাবার প্রচ্ছন্ন মদত এই পরিবারে মায়ের অবস্থানকে স্পষ্ট করে। পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ এতটাই গভীরে যে যেকোন সিদ্ধান্তে বাবার মতামতই শেষ কথা। কিশলয় এক অসাধারন দৃশ্যকল্প নির্মাণ করেন যখন নিছক প্রেম করার জন্যে ছোট ভাই তার দিদিকে একটা চড় মারে। সমস্ত দর্শকের শিরদাঁড়া দিয়ে হিমশীতল স্রোত বয়ে যায়। এক মুহূর্তে পরিষ্কার হয়ে যায় যে হিন্দুত্ব-প্রভাবিত আজকের এই প্রজন্ম পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণকে লাগু রাখার জন্যে হিংসার সুযোগ নিতে মুহূর্তের জন্যে পিছপা হয় না। যেখানে ওদের বাবা কিন্তু সরাসরি হিংসার আশ্রয় নিতে পিছিয়ে আসে। মিসেস শর্মার আরেকজন বন্ধু জোটে, যে মিসেস শর্মার মতোই নদীর তীরে একাকীত্ব উপভোগ করতে যেত। একটি অল্পবয়সী মেয়ে, যে পার্লারে কাজ করে। সেই সখ্যতা মিসেস শর্মাকে নিজের জগত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আরো বেশি আগ্রহী করে তোলে। একদিন ওই মেয়েটির সাথে মিসেস শর্মা চলে যান রাত্রিবেলা নদীর ধারে। রাত্রির নিস্তব্ধতায় নদী এবং আকাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে মিসেস শর্মা যেন এক নতুন জগতে চলে যান। সমস্ত সিনেমা জুড়ে একটা পরিবারের মধ্যে পিতৃতান্ত্রিকতার বহমানতার নানা ঘটনা কিশলয় সামনে নিয়ে এসেছেন। সে যে কতটা জগদ্দল এবং ক্ষমতালোভী তা বোঝানোর জন্যে মিসেস শর্মার নদীর ধারে একলা দাঁড়িয়ে থাকা আর পেছনে পিতৃতান্ত্রিক প্রতিভূ হিসেবে একটা বুলডোজারের উপস্থিতি অসাধারন দৃশ্যকল্প। শুধু তাই নয়, এলাহাবাদ যখন প্রয়াগরাজে রূপান্তরিত হচ্ছে, সারা শহর জুড়ে বেশ কিছু ফ্রেম অনায়াসে বুঝিয়ে দেয় এই পরিবর্তনের স্বরূপ। একইভাবে পিতৃতান্ত্রিকতার ঘৃণ্যরূপ সম্পূর্ণভাবে প্রকাশিত হওয়ার পর তাকে প্রতিহত করতে না পেরে মিসেস শর্মার স্নানের দৃশ্যটি খুব অর্থবহ। যেন উনি এই সমস্ত ক্লেদ থেকে, এমনকি নিজের মনের মলিনতার থেকেও নিজেকে মুক্ত করলেন। এ যেন এক দিকনির্দেশ। এভাবেও রুখে দাঁড়ানো যায়। স্বতঃস্ফুর্ত করতালি দিয়ে শেষ হয় ‘অ্যায়সে হী’। কিশলয়ের সাথে পরবর্তী কথোপকথনে নানা প্রশ্ন উঠে আসে। কস্তুরী প্রশ্ন করেন মিসেস শর্মাকে এই ভূমিকায় নির্বাচন করা নিয়ে, প্রশ্ন ওঠে ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ ব্যবহারের প্রসঙ্গটি নিয়ে। কিশলয় জানান যে মিসেস শর্মাকে খুঁজে পেতে তাদের বেশ বেগ পেতে হয়েছে। শেষপর্যন্ত মুম্বাই এর একজন থিয়েটার আর্টিস্টকে তারা বাছাই করেন। স্টীল ফটো ব্যবহার করার প্রসঙ্গে কিশলয় জানান তিনি ফ্ল্যাশব্যাকের পরিবর্তে এই ব্যাপারটা ভেবেছেন। যাতে বিষয়টাকে আরও বাস্তব করে তোলা যায়। সমস্ত পরিবারেই যেহেতু ফটো অ্যালবামের একটা বিশেষ গুরুত্ব থাকে তাদের পুরনো স্মৃতিকে চাগিয়ে তোলার জন্যে।

‘অ্যায়সে হী’ শেষ হওয়ার পরেও দীর্ঘক্ষণ তার রেশ রেখে যায়। সেই রেশ নিয়েই দর্শক ঘরে ফেরেন দ্বিতীয় দিনের শেষে। তৃতীয় দিনের অপেক্ষায়।

রিপোর্ট – অনিন্দ্য দত্ত, সুমিত গাঙ্গুলি, সৌম্য বসু
ছবি- অনিমেষ, অর্কপ্রভ, আনিরুদ্ধ, নিবেদিতা

নবম কলকাতা পিপল্‌স ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল
২০ জানুয়ারী-২৩ জানুয়ারী
উত্তম মঞ্চ, হাজরা
প্রবেশ অবাধ

0 replies

Leave a Reply

Want to join the discussion?
Feel free to contribute!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *