।।ফেস্টিভ্যালের ডায়েরি।প্রথম দিন-২০ জানুয়ারী।।

,

পিপলস ফিল্ম কালেকটিভ আয়োজিত কলকাতা পিপল্‌স ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল নবম বর্ষে পা দিল। এ বছর উৎসবের উদ্বোধনী ছবি ছিল ‘আ নাইট অফ নোয়িং নাথিং’। তরুণ চিত্রনির্মাতা পায়েল কাপাডিয়া নির্দেশিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের সিনেমা। এর আগে তিনি স্বল্পদৈর্ঘ্যের দুটি সিনেমা করেছেন, ‘আফটারনুন ক্লাউডস’ আর ‘এন্ড হোয়াট ইস দ্য সামার সেয়িং’ নামে। ‘আ নাইট অফ নোয়িং নাথিং’ এদিন কলকাতায় প্রথমবার প্রদর্শিত হল। প্রথম দিনের প্রথম সিনেমায় দর্শকের সংখ্যা ছিল চোখে পড়ার মতো।

সিনেমাটির মূল প্রেক্ষাপট হলো ২০১৫ সালে পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ছাত্র আন্দোলন। ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে দেশের মসনদে বসে। বিজেপির মূল মন্ত্রদাতা আরএসএস। তাদের মূল লক্ষ্য ভারতে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। তারই পরিপ্রেক্ষিতে তারা সরকারের মাধ্যমে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়। তার মধ্যে একটি প্রধান পদক্ষেপ ছিল শিক্ষাঙ্গনগুলিকে দখল করে, শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রছাত্রীদের স্বাধীনতা শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে তাদের ভাবধারায় পুনর্বিন্যস্ত করা। অতএব, ‘মহাভারত’ নামক একটি মেগাসিরিয়ালে অভিনয় করা গজেন্দ্র চৌহানকে ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ। এর ফলে ফিল্ম ইন্সটিটিউটের ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পরে। পায়েল এই আন্দোলনের চিত্ররূপ তৈরী করেছেন ব্যাপারটা এমন নয়। তার মুন্সিয়ানা এখানেই, যে তিনি এই আন্দোলনের থেকে বেরিয়ে গিয়ে আরো গভীরে বিশ্লেষণ ও ছাত্রী হিসেবে অনুভব করার চেষ্টা করেছেন। ‘এল’ একজন ছাত্রী। সে চিঠি লিখছে তার প্রেমিককে। সেই প্রেমিকের হয়তো কোন অস্তিত্বই নেই। এই যাদুবাস্তবতাকে পায়েল তার বেশ কিছু দৃশ্যে, বিশেষ করে স্বপ্নের দৃশ্যায়নে অসাধারণ প্রয়োগ করেছেন। এই চিঠির বয়ানে ও পাঠে আমরা পরপর ঘটে যাওয়া ঘটনার স্মৃতি নিয়ে জেগে উঠি। রাষ্ট্র একের পর এক ছাত্রদের উপর তার নির্মম শর্তগুলি চাপানোর চেষ্টা করে চলে যাতে কোন বিরোধী মতামত যেন আর তৈরি না হয়। ছাত্ররা সজোরে সেই চাপিয়ে দেওয়া শর্তগুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। জেএনইউ-র ছাত্রদের আন্দোলন এবং রাষ্ট্রের নির্মম আক্রমণ থেকে শুরু করে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার লাইব্রেরিতে পুলিশের লাঠিচার্জ ও ধরপাকড়, অন্যদিকে জাতিবিদ্বেষের শিকার হয়ে রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যা এবং তার প্রতিবাদে হায়দ্রাবাদ ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের বিক্ষোভে ফেটে পরা, তৎপরবর্তী পুলিশের নির্মম দমন প্রক্রিয়া, এসবই ‘এল’ এর চিঠিতে স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু এই পাঠে কোন উত্তেজনা নেই। আছে অদ্ভুত এক ভয়মিশ্রিত সত্যদর্শন বা বলা চলে আত্মদর্শন যেখানে আশেপাশের জগত কেমন পাল্টে যায়, আঁধারে তলিয়ে যায়, এতটাই, যে তাকে আর চেনাই যায় না। পায়েল আরো একধাপ এগিয়ে আমাদের অন্তর্নীল সত্তাকে প্রশ্নে জর্জরিত করে তুলছেন, যখন চিঠির বয়ানে আমরা জানতে পারছি যে ‘এল’-এর প্রেমিক, যে কিনা ইউনিভার্সিটির আন্দোলনে একজন আপোষহীন সৈনিক হওয়া সত্ত্বেও নিজের ব্যক্তিগত জীবনে নিজের পরিবারের চাপিয়ে দেওয়া শর্তর বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে পারছে না, পারছে না ‘এল’কে স্বীকার করতে কারন সেই প্রেমিক ‘এল’-এর থেকে “উঁঁচু” জাত। কোথাও যেন পায়েল আমাদের ছোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যে এই না-চেনা জগতের অস্তিত্ব বিরাজ করছে আসলে আমাদের অন্তরে, আমাদের মননে।

পুনের ছাত্র আন্দোলনের রেশ মনে রেখেই দর্শক পৌঁছে যান আফগানিস্তানে। পরিচালক মহম্মদ রেজা কেশওয়ারির ‘সনম ‘। ১৯ মিনিটের ছবিটি একজন তরুণী আফগান র‍্যাপ-গায়িকার বিচার ও বিচার-পরবর্তী সঙ্কটময় জীবন অনুসারে নির্মিত। একবছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দখলদার সেনা সরিয়ে নিলে আফগানিস্তান সহজেই তালিবান দ্বারা পুনরধিকৃত হয়। বহু আফগান সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে চলে যান। এইরকম টালমাটাল সময়ে ওই র‍্যাপ-গায়িকার জীবন ওলটপালট হয়ে যায়। তার পরিবার আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সে নিজেও বুঝতে পারে তার জীবনও সঙ্কটে। সে ইরানে চলে যাওয়ার সময় রাস্তায় বিমান থেকে বোমা-হামলার সামনে পড়ে, রোয়া নামের একটি শিশু পিতামাতাকে হারিয়ে তার সঙ্গ নেয়। এরপর তালিবানদের সঙ্গে একপ্রকার লড়াই করে ইরানে গিয়েও তাকে পড়তে হয় প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে। দেশে দেশে মহিলাদের মানবিক অধিকারের যেন মুখ হয়ে ওঠে সে।

আসলে মেয়েদের ওপর রাষ্ট্রের নিপীড়নের বিষয়টি দেশ-কাল-সীমানা অতিক্রম করেই সত্যি। এই সুর ধরেই এদিনের তৃতীয় ছবি ভারতের মালয়ালম ভাষায় তৈরী ‘লক্ষ্মী’। কলকাতায় প্রথমবার দেখানো ছবিটির চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় তরুণ নির্দেশক, কেরালার হ্যারল্ড অ্যান্টনি পলসন, চিত্রগ্রহণে রমন উন্নি, সম্পাদনায় যুগেশ ভোস্কর, শব্দগ্রহণে হরি নারায়ণন,সঙ্গীত পরিচালনায় জন পি ভার্কি। ‘লক্ষ্মী’ বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এবং এন আর সি-র পটভূমিকায় কেরালার একটি অভিবাসী শ্রমিক পরিবারের কাহিনী। প্রধান চরিত্র লক্ষ্মীর জীবনের মধ্যে দিয়ে কেরালার বাঙালি অভিবাসী শ্রমিকদের জীবন, জীবিকা এবং নিয়মিত ঘটে চলা অন্যায্য সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে উঁকি দিয়েছেন পরিচালক। প্রধান চরিত্র লক্ষ্মী তাঁর নিখোঁজ স্বামীর সন্ধান করেন, তাঁর নিজের এবং তার মেয়ের গভীর স্মৃতি, কষ্ট এবং যন্ত্রণাকে ফুটিয়ে তোলেন। তাঁর লড়াইয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় তাঁর মেয়ের স্কুলের এক শিক্ষক। তাতেও সমস্যা শুরু হয়। লক্ষ্মী অবশেষে তাঁর মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে পড়েন।

কেরালা থেকে এরপর আমরা পৌঁছে যাই আরো দক্ষিণে। শ্রীলঙ্কার মুসালি অঞ্চলের দক্ষিণে অবস্থিত গ্রাম পালাইকুলি। এই অঞ্চলটি শ্রীলঙ্কার ৩০ বছরের গৃহযুদ্ধ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। দীর্ঘ বিশ বছর পর এলাকা থেকে বাস্তুচ্যুত তামিল মুসলিমরা তাঁদের ছেড়ে যাওয়া ভিটেতে ফিরে আসছেন। পুনর্বাসনের জন্য তাদেরকে রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্রের সাথে লড়তে হচ্ছে। তাঁদের এই অসম লড়াইয়ের রোজনামচা নিয়েই নির্মিত সুমথি শিবমোহনের ছবি ‘অ্যামিড দ্য ভিলাস’, এদিনের পরবর্তী চলচ্চিত্র। ইতিহাস, স্মৃতি, আনন্দ, প্রতিকূলতা এবং সংগ্রামের বহুমাত্রিক ক্যানভাসে শ্রীলঙ্কার তামিল মুসলিমদের জীবনের জটিলতাকে বোঝার চেষ্টা দেখা যায় ছবিতে।

উৎসবের প্রথম দিনের দ্বিতীয়ার্ধ্বে আমরা এসে পৌঁছই ঝাড়খন্ডে। সেখানে, একটি ইউরেনিয়াম খনির এলাকায়, এক আদিবাসী দম্পতি তাদের মেয়েকে হারানোর স্মৃতির সঙ্গে লড়াই করছেন। তাঁদের কন্যার যাবতীয় স্মৃতির সাক্ষী জল, জমি, মাঠ, জঙ্গল। অসাধারণ সংবেদনশীলতা এবং মরমী চিত্রগ্রহণের মাধ্যমে চলচ্চিত্রটি খুঁজে বেড়ায় সাঁওতাল আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবনবোধের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা প্রকৃতিকে। তাঁদের উৎসবের প্রাণবন্ত রঙ, তাঁদের লোকগীতি, এবং সমষ্টি হিসেবে বেঁচে থাকার জীবনদর্শন, যা তাঁদের একত্রে আবদ্ধ করে। ‘টরটয়েস আন্ডার দ্য আর্থ’ একটি কাব্যিক উপাখ্যান, দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যাওয়া এক জগতের কাহিনী, যা অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়নের বিরোধিতা করে, প্রাণ প্রকৃতি সংরক্ষণের মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করে। ছবিটির ধীর গতি এক অর্থে নাগরিক বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের গতিসর্বস্বতা ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া মানসিকতার সমালোচনা হিসেবে উঠে আসে। এমনিতেই সাঁওতালি ভাষায় ছবি খুবই কম হয়, হলেও সেখানে আদিবাসী নন, এমন মানুষই আদিবাসী চরিত্রে অভিনয় করে থাকেন। সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ নগরজীবনের যান্ত্রিকতার সমালোচক হয়েও এই ত্রুটি থেকে মুক্ত নয়। এমন চালু কাঠামো ভেঙে এখানে অভিনয় করছেন আদিবাসী মানুষজন। উঠে এসেছে তাঁদের নিজেদের গান। কোনও উচ্চবর্ণ ব্যক্তিবর্গের দৃষ্টিভঙ্গীতে বা তাঁদের দ্বারা নির্মিত কাঠামোয় নয়, বরং নিজেদের ভাষ্যে নিজেদের জীবনের গল্প বলার বিষয়টি শিশির ঝা নির্মিত এই ছবিটিকে জরুরি করে তোলে।

পরের ছবি ‘হিয়ার ইজ হোয়্যার উই মিট এগেইন’ একটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র। পরিচালক মুস্তাফা পাকিস্থানের একজন তথ্যচিত্র নির্মাতা। গত প্যান্ডেমিকের সময় যখন প্রতিটি মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল তার আশেপাশের জগতের থেকে, তখন একজন প্রবাসী মানুষ, যে কাজের জন্যে তার নিজের জগত থেকে বহুদুরে থাকতে বাধ্য হয়েছিল, তাকে তুলে ধরে এই ছবি। তার সারা দিন কাটে অপেক্ষায়, একটা খবর, একটা ফোনের জন্যে। তখন তার মনন জুড়ে যে জীবনযন্ত্রণা, তারই এক চিত্ররূপ এই ছবি। সারাদিন একটি বেড়ালের সাথে তার সখ্য, যে বেড়ালটিও আসলে নিঃসঙ্গ। সেও শুধু খায়, ঘুমোয় আর অপেক্ষা করে। সেও একদিন চিরদিনের মত ঘুমিয়ে পরে। আবার সেই একাকীত্বই সঙ্গী। ফোনে মার সাথে তার কথা হয়, কোথাও বিস্ফোরণ হয়েছে তার খবর শোনে। যদিও তার থাকার কথা ছিল মায়ের সাথে, কিন্তু পরিস্থিতি তাকে সেই সুযোগ দেয় নি। শেষে একদিন ঘরে ফেরার সুযোগ আসে। দেওয়ালে লাগানো স্মৃতিগুলো আস্তে আস্তে খুলে নিতে নিতে ক্যামেরা জুড়ে তৈরি হয় এক অসাধারণ দৃশ্যকল্প।

পরবর্তী ছবি মুন্তাহা আমিন নির্দেশিত স্বল্পদৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র ‘এ সিজ ইন দ্য এয়ার’। ২০১৯ সালে কাশ্মীরের জন্যে চালু থাকা সংবিধান স্বীকৃত ৩৭০ ধারা কেন্দ্রের বিজেপি সরকার রদ করে। তার ফলস্বরূপ কাশ্মীরকে সম্পূর্ণ বন্ধ করে ফেলা হয় অঘোষিত ভাবে। সমস্ত স্থানীয় পার্টির নেতাদের হয় জেলে পোরা হয় অথবা গৃহে অন্তরীণ করে রাখা হয়। কাশ্মীরকে ভারতের মূল ভূখন্ড থেকে এবং এক অর্থে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। সমস্তরকম সংবাদ আদানপ্রদানের মাধ্যম বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় ইন্টারনেট পরিষেবা। এই প্রেক্ষিতে মুন্তাহা আমিনের এই ছবিটি নির্মিত। বিশেষত কাশ্মীরি মেয়েদের অন্তরঙ্গ বয়ানের মধ্য দিয়ে মুন্তাহা ফুটিয়ে তোলেন এক অদ্ভুত বিচ্ছেদ এবং ভয়মিশ্রিত বেদনার কাহিনি। নানা কথোপকথনে একের পর এক উঠে আসে ইন্টারনেট ব্লকেড ও কাশ্মীরের রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মাঝে তাদের দৈনন্দিন আশা আকাঙ্খার কথা, যাপনের কথা, স্বপ্নের কথা। ছাত্রীদের ভাষ্যে উঠে আসে তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা। তাই অকস্মাৎ যখন এই আশা আকাঙ্খাগুলি, ভবিষ্যত পরিকল্পনাগুলি এক মুহুর্তে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় এক অনিশ্চিত সময়ের অন্ধকারে, তখন সেই আশাহত অবস্থা এক ভয়ের জন্ম দেয়। কেউ বেছে নেয় আল্লাহর স্মরণ, কেউ চিঠি লেখে বন্ধুদের আর ফেরতা চিঠির অপেক্ষায় দিন গোনে, কেউ মাইলের পর মাইল হেঁটে বন্ধুকে এক লহমার জন্য চোখের দেখা দেখত যায়। এই যাওয়ার, বা অন্তহীন অপেক্ষার কোনও গন্তব্য নেই, শুধু এই দিনযাপনে লেখা হয়ে যায় এক ভয়ার্ত অনিশ্চয়তার স্মৃতি। সারা সিনেমা জুড়ে মাঝে মাঝেই এসে পড়ে ঝিলম নদীর ওপর এক জনহীন সেতু পেরোনোর দৃশ্য, যা শেষপর্যন্ত আর পেরোনো হয়ে ওঠে না। কিন্তু দৃশ্যকল্পটি আশা জাগায়, ওই সেতু পেরোলেই হয়ত সে পৌঁছে যেতে পারবে এক মুক্ত পৃথিবীতে।

এদিন উৎসবের উদ্বোধনী ভাষণে দ্বৈপায়ন বলেন পিপল্‌স ফিল্ম কালেকটিভের দশ বছর ও কলকাতা পিপল্‌স ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের নয় বছরের পথ চলার কথা। সিনেমা নির্মাণ ও প্রদর্শনের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তুলে আনেন আর-এস-এস-বিজেপির কথা। কীভাবে তারা সিনেমাকে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে ব্যবহার করছে সেদিকে তাকালে আমাদের করণীয় অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যায়। উঠে আসে সিনেমা, সাহিত্য, সংস্কৃতির পরিসরগুলির উপর কর্পোরেট দখলদারির কথা। শহরে শহরে কর্পোরেটের টাকায় সাহিত্য ও সিনেমা উৎসব একাধারে সেই সিনেমা-সাহিত্যের রাজনীতিকে ভোঁতা করে দেয়, জনতাকে সাহিত্য সিনেমা থেকে বিচ্ছিন্ন করে, সমাজের মুখে কুলুপ এঁটে দেয় ও কর্পোরেটের মতাদর্শের একাধিপত্য নির্মাণের কাজ করে। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমাদের সিনেমা দেখানোর পরিসর স্রেফ জনতার উপর নির্ভর করে গড়ে তোলার প্রয়োজন তাঁর কথায় উঠে আসে।

ঝাড়খন্ডের প্রবীণ চিত্রপরিচালক ও সমাজকর্মী মেঘনাদ এরপর সদ্যপ্রয়াত তথ্যচিত্রনির্মাতা কে পি শশীকে স্মরণ করে একটি বক্তৃতা দেন। ‘প্রত্যহ যারা ঘৃণিত আর পদানত/ দেখো আজ তারা সবেগে সমুদ্যত/ তাদেরই দলের পিছনে আমিও আছি/ তাদেরই মধ্যে আমিও যে মরি বাঁচি/ তাই তো চলেছি দিনপঞ্জিকা লিখে’ – কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের লাইনগুলি দিয়ে তিনি বর্ণনা করেন তাঁর বর্ণময় বন্ধু শশীকে। চিত্রনির্মাতা শশী, কার্টুনশিল্পী শশী, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠক শশী, মানবদরদী শশী, যুদ্ধবিরোধী শশী – নানান ছোট ছোট ঘটনার মধ্যে দিয়ে মেঘনাদ প্রাণবন্ত করে তোলেন শশীকে, অকালে তাঁর চলে যাওয়ার শূন্যতাও রিনরিন করে বাজতে থাকে প্রেক্ষাগৃহে। শশীর বানানো প্রায় পনেরোটি ছবির পরিচয় দেন মেঘনাদ। বলেন ‘গাঁও ছোড়ব নাহি’ গানটির মিউজিক ভিডিও বানানোর কাহিনি।

উদ্বোধনী পর্ব শেষ হয় ইরানের আরাশ মনসুর গরগানির স্বল্পদৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র ‘মাহসা’র প্রদর্শনের মধ্যে দিয়ে। ইরানের সাম্প্রতিক নারী আন্দোলনের পটভূমিকায় তৈরি ছবি। মাহসা মারা যায়, আসলে ইরানের নীতি পুলিশের হাতে হিজাব ঠিকভাব না পরার অভিযোগে খুন হয়। এই ঘটনায় সারা ইরান জুড়ে সাধারণ মানুষ নারী পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিবাদে সামিল হয়, এই নীতি পুলিশ থেকে শুরু করে সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে। তারই কিছু টুকরো টুকরো ছবি এবং ভিডিও খুব সন্তর্পণে এবং লুকিয়ে তোলা দৃশ্য জুড়ে জুড়ে এই তথ্যচিত্রটি নির্মিত। ইসলামিক নীতিশাসন, যা পুরুষতন্ত্রের এক ভয়ঙ্কর আগ্রাসী রূপে ইরানে প্রতিষ্ঠিত, সেই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর এই দৃশ্যগুলি প্রতিরোধের একটা দলিল হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়, আমাদের এই আঁধারেও স্বপ্ন দেখায়। মাহসার মায়ের কান্না প্রেক্ষাগৃহের বাতাসকে ভারি করে তোলে।

পরবর্তী ছবি রাজকুমারী আস্থানা নির্মিত ‘জব তক রাত বাকি হ্যায়’। পঞ্চাশ মিনিট দৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্রটি নির্মিত হয়েছে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কৃষক আন্দোলনের উপর। ২০২০ সালে প্রায় প্যান্ডেমিকের মধ্যে বিজেপি সরকার তিনটে কৃষি আইন পার্লামেন্টে পাস করে। উত্তরভারতের বিশেষ করে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান এবং উত্তরপ্রদেশের একাংশ বিক্ষোভে ফেটে পরে। প্রথমে নিজের নিজের প্রদেশে এই বিক্ষোভ শুরু হয়, পরে সবাই একযোগে দিল্লি ঘেরাও করে। বিভিন্ন সীমান্ত প্রদেশগুলি থেকে দিল্লী ঢোকার যত রাস্তা আছে সমস্ত রাস্তায় তারা জমায়েত করে। কয়েক লাখ কৃষক তাদের পরিবার নিয়ে এক দীর্ঘ সময়ের জন্যে অপেক্ষা করার প্রস্তুতি নিয়ে জমা হয় এই রাস্তাগুলিতে। রাজকুমারী তার ক্যামেরা নিয়ে পৌছে যান এই আন্দোলনের দোরগোড়ায়। তাঁবুতে তাদের সাথে থেকে ক্যামেরাবন্দী করেন তাদের দৈনন্দিন কর্মকান্ড, তাদের সংগঠিত হওয়ার প্রক্রিয়া, আর তার সাথে বিভিন্ন বৈষম্যের সহাবস্থানের রূপ। আমরা বিস্ময়ে লক্ষ্য করি এই জমায়েতের ব্যাপকতার চেহারা। তাদের অস্থায়ী বাসস্থানগুলিকে এক দীর্ঘমেয়াদী বাসস্থান হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা। খাদ্যসংগ্রহ ও বন্টনের সমবায় রূপ। আর তার সাথে এক দীর্ঘ লড়াইয়ের অঙ্গীকার এবং নিজেদের সংগঠিত রাখার নানা প্রয়াস। বিশেষ করে মহিলাদের যোগদান এবং এই ভারতবর্ষের ভয়ঙ্কর পুরুষতান্ত্রিক অবশেষের মধ্যেও তাদের উপস্থিতি ও সক্রিয় অংশগ্রহণ কোথাও যেন আশা জাগায়, যে আন্দোলনই পারে সমস্ত বৈষম্যকে দূরে সরিয়ে রাখতে। হয়তো এই আন্দোলন শেষ হয়ে গেলেও এই বৈষম্যহীনতা মনের গভীরে তার চারা তৈরী করে রাখতে পারবে। সঙ্গত ভাবেই রাজকুমারী জাঠ এবং দলিতদের বৈষম্যের প্রসঙ্গ তোলেন আন্দোলনকারীদের সাথে কথোপকথনে। মনে করান দলিত ক্ষেতমজদুরদের অনুপস্থিতিতে এই আন্দোলন দুর্বল হয়ে যেতে পারে। বিপন্নতাবোধই মানুষকে মতাদর্শগতভাবে সক্রিয় করে তোলে, নতুন করে ভাবতে শেখায়। আশা করা যায় এই বিপন্নতাবোধই হয়তো এই বৈষম্য দূর করতে পারে।

বেশ কিছুদিন আগে কমল চক্রবর্তীর লেখা ব্রহ্মভার্গব পুরান পড়ছিলাম। সেই আমার হিজরা সম্প্রদায়ের সম্পর্কে একটু গভীরে জানার চেষ্টা। যারা নিজেদের জন্ম নিয়ে সমাজের এক চরম পরিহাসের শিকার। ‘আর জন্মে ছ্যাইলা কর, আর জন্মে মাইয়া কর, জগন্নাথ হে’, এই আর্তিতে তাদের আকাশ বাতাস ভারাক্রান্ত। এদেরই আরেক খন্ডরূপ আমাদের সামনে উপস্থিত করলেন এস এ হানান ও সুরভী দেওয়ান এই তথ্যচিত্রে। কাশ্মীরের এই মানুষগুলির জীবন অতীতে এমন ছিল না। রাজসভায় বা সুলতান বাদশাহদের সভায় তারা যেমন নৃত্য গীত পরিবেশন করতেন তেমনই সুলতান বাদশাহদের একাধিক বেগমদের দেখভাল ও পাহারা দেওয়ার কাজেও তারা নিযুক্ত হতেন। কিন্তু ক্রমশঃ পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আজ তাদের মর্যাদা রক্ষার জন্যে শুধু নয়, মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্যে লড়াই করতে হচ্ছে। কথোপকথন এবং সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে ক্যামেরা আমাদের সামনে তুলে ধরল কাশ্মীরের এক অন্য চিত্র। যাদের কথোপকথন শুনলাম তারা প্রত্যেকেই গ্রামসমাজে প্রত্যাখ্যাত। প্রায় কিশোর বয়সে পালিয়ে এসে হাজির হয়েছে এই শ্রীনগরে। বড়ো শহর, সুযোগ অনেক বেশি আর অনধিকার চর্চা কম এই আশায়। কিন্তু সবসময় তা সম্ভব হয় নি। শুধুমাত্র ভিন্নতার কারণে এই দ্বিমাত্রিক সমাজে তারা পড়াশুনা করে উঠতে পারে নি। তারফলে তাদের জীবিকার সুযোগ গেছে কমে। রাজনৈতিক আবর্তে সেই কম সুযোগও হাতছাড়া হয়েছে। এদের মূল উপজীব্য ছিল বিবাহের ঘটকালি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেখানে ঢুকে গেছে সংগঠিত কোম্পানীগুলি। তাদের একমাত্র আশা কিছু সমাজকর্মী যারা সরকারের সাথে নানাভাবে আলাপ আলোচনা করে কিছু মৌলিক অধিকার এবং সুযোগ সুবিধা আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এই যৌথ চেষ্টায় আশা করা যায় যে, কোনদিন হয়তো মানুষ ‘স্বাভাবিক’ আর ‘অস্বাভাবিক’ এই দ্বিমাত্রিক ভাবনাকে ভুলে সবকিছুকেই স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারবে। এই তথ্যচিত্রটিতে সঙ্গীত ও কবিতা এক অনবদ্য ভূমিকা নিয়েছে। দিনের শেষে সেই রেশ মনে নিয়েই ঘরে ফেরা, উৎসবের দ্বিতীয় দিনের অপেক্ষায়।

রিপোর্ট – অনিন্দ্য দত্ত, সুমিত গাঙ্গুলি
ছবি- অনিমেষ, অর্কপ্রভ, আনিরুদ্ধ, নিবেদিতা

নবম কলকাতা পিপল্‌স ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল
২০ জানুয়ারী-২৩ জানুয়ারী
উত্তম মঞ্চ, হাজরা
প্রবেশ অবাধ

0 replies

Leave a Reply

Want to join the discussion?
Feel free to contribute!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *