।।ফেস্টিভ্যালের ডায়েরি।চতুর্থ দিন-৩ এপ্রিল।|

,

পর্ব ১ –
অষ্টম কলকাতা পিপলস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের শেষ দিনের সময়সূচীতে ছিল আটটি ছবি। দিনের শুরুতেই দেবলীনা মজুমদারের পূর্ণদৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র “গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি”। কেপিএফএফ-এর দর্শকের কাছে দেবলীনা পরিচিত মুখ। ফেস্টিভ্যালে তাঁর আগের ছবি “তিন সত্যি”র গল্প বলার স্টাইল রেশ রেখে গেছে এই ছবিটিতেও। কমেডি যদি ট্রাজেডির লং শট হয় তাহলে এই ছবি পারফেক্ট ট্রাজেডি। ছবিটি তিনটি চরিত্রের আশেপাশে ঘুরপাক খায় যারা তাদের বিবাহের সম্ভাবনাগুলি নতুনভাবে খতিয়ে দেখছে। তাদের মধ্যে একজন পরিচালক স্বয়ং যিনি তাদের এই খোঁজকে ক্যামেরাবন্দী করছেন। তিন চরিত্রের মধ্যে সায়ন এবং গৌরব পুরুষ, দেবলীনা মেয়ে। তারা তিনজনই সমলিঙ্গের সঙ্গী খুঁজছেন এবং সমলিঙ্গের সঙ্গীকে বিয়ে করতে চাওয়ার ফলে তাদের চারপাশের সমাজ বিভ্রান্ত, উদ্বেগে অস্থির। নানা ধরনের গুঞ্জন থেকে শুরু করে অবিশ্বাস, বিবাহের সমালোচনা উঠে আসে তাদের বন্ধু ও আত্মীয়বৃত্ত থেকে। বিবাহের প্রতিষ্ঠানটিকে সামাজিক, জৈবিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে দেখার বহুস্বর ছবিটিকে এক প্যানোরামিক রূপ দেয়।

এই ছবির অন্যতম প্রধান চরিত্র আইন। ৩৭৭ ধারা থাকা সত্ত্বেও সমলিঙ্গের দম্পতিরা অনাদিকাল থেকে বিবাহ সহ বিভিন্ন প্রতীকী কোডের মাধ্যমে তাদের যৌথ পথচলা উদযাপন করে আসছে।  একই সাথে বিসমলিঙ্গের দম্পতিদের সমান সমান সামাজিক স্বীকৃতির দাবি নিয়ে চলেছে আন্দোলন। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে শুট করা ডকুমেন্টারিটি ৩৭৭ ধারাকে আইনিভাবে পুনর্সংজ্ঞায়িত করার মুহূর্তটিকে (৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮) ধরে তৈরি হয়েছে। যারা প্রজননকেন্দ্রিক আইনি খাঁচার বাইরে যৌনমিলনের স্বীকৃতির জন্য লড়াই করেছিল তাদের জন্য একটি ঐতিহাসিক জয়ের প্রতীক এই দিন। ফিল্মটির সমাপ্তি ঘটে বিয়ের ঠিক-ভুল দ্বন্ধ নিয়ে বিতর্কের মাধ্যমে। ২০১৪ সালে কেন্দ্রে নতুন ফ্যাসিস্ট সরকার, তাদের নির্দিষ্ট রাজনীতির নতুন ধাঁচা যে অবধারিতভাবেই এই আন্দোলনের মধ্যেকার প্রগতিশীল দিকগুলোকে ভোঁতা করে দেবে, এই আশঙ্কার দোলাচল ছবিটিতে উঠে আসে।

বহুবিচিত্র এই আন্দোলনের মধ্যেই, সমকামী বিবাহের ইস্যুতে একটি তীক্ষ্ণ মতাদর্শগত বিভাজন রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক রাজ্য, ইউরোপের কিছু দেশ সমকামী বিবাহকে অনুমোদন দেওয়া যখন শুরু করে, তখন সেখানে অনেক ক্যুয়ার সমাজকর্মী বলেছেন যে প্রথাগত বিয়ে করলে তবেই রাষ্ট্রের সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার সুবিধা পাওয়া যাবে এই প্রলেপ লাগিয়ে রাষ্ট্র আদতে তাদের যৌথজীবনের অন্য সম্ভাবনাগুলিকে বিনষ্ট করেছে। এইভাবে যারা বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা রাষ্ট্রের সামাজিক সুরক্ষার পরিধির বাইরে থেকে যায়। তাছাড়া বিবাহকে পিতৃতন্ত্রের একটি নিপীড়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা যায়। অন্যদিকে, যারা সমকামী বিবাহের পক্ষে তারা যুক্তি দেন যে যদি রাষ্ট্রের সকল নাগরিক সমান হয়, তাহলে কোনও ব্যক্তির যৌন অভিমুখ, শ্রেণী, জাত ইত্যাদি নির্বিশেষে যে কেউ বিয়ে করতে পারে, নিয়ম ও বিভিন্ন উপায়ে যৌথজীবন বেছে নেওয়ার ক্ষমতা সবার ক্ষেত্রেই সমান হওয়া প্রয়োজন। পরিচালক নিজেই এসব বিতর্কের সঙ্গে যুক্ত হতে চান। আইনের কচকচি থেকে বেরিয়েও, ভারতের প্রেক্ষাপটে যেখানে সমকামিতা নিজেই এক “সামাজিক অপরাধ”, সেখানে সমকামী বিবাহ কামনা করার অর্থ কী? এমন ইচ্ছাকে রাষ্ট্র কীভাবে দেখবে? এই প্রশ্ন উঠে আসে ছবিতে ও চিত্রনির্মাতার সাথে ছবি-পরবর্তী কথোপকথনে।

পিতৃতন্ত্রের অভিশাপ ও বিবাহের খাঁচা এদিনের পরের ছবিটিরও মূল প্রাণ। স্বল্পদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র “অরুণা” এক সদ্যবিবাহিত (পনের মাসের সম্পর্ক) নারীর গল্প বলে, যে সংসার ছেড়ে নিজের ছোট বোনের সঙ্গে আলাদা থাকে এবং একটি স্বাধীন জীবন আবিষ্কার করে। পারিপার্শ্বিক সংস্কারের মধ্য থেকে লড়াই করে নিজের আবেগ অনুভূতিকে একটি বিশেষ আকার দিতে সক্ষম হয়।

মূলতঃ একজন বিবাহিত কিন্তু পৃথক/একক ইউনিটে থাকা মহিলা যখন সমাজের নজরবন্দিতে পড়ে যায় তখন বহু পাড়া-পড়শির বিরাগের কারণ হয় এবং সামাজিক বাঁকাচোখের নিশানা হয়ে ওঠে। কমবয়সি ছেলেদের কৌতূহলী নজর ও মাঝবয়সি গৃহিণীর সমালোচনামূলক নজর উভয়ের মধ্যে দিয়েই তাকে যেতে হয়।  এই যাত্রার ছবি মরমীভাবে বড় পর্দায় ফুটিয়ে তোলে অক্ষয় এস পোদ্দার নির্দেশিত “অরুণা”।

কাহিনীটি ‘সবরীমালা’র ঘটনার সমকালীন, ফলতঃ ন্যারেটিভে তার প্রতিফলন উঠে এসেছে, উঠে এসেছে টিভি সিরিয়ালের মহাভারতীয় ন্যারেটিভ এবং অবশ্যই আইনজীবীর উপেক্ষা ও অন্য ধরণের সহানুভূতি এবং অবশ্যই কৌতূহল। প্রতি মুহূর্তের তুলনা, প্রতিবেশীর বিনা প্রয়োজনে অহেতুক আগমন, সবকিছুই উঠে আসে এই ছবিতে। সঙ্গে থাকে বোনের ব্যক্তিগত সমস্যা। 
একুশ শতকেও যে বৈবাহিক সংসার পরিত্যাগ করলে সংকট সঙ্গ ছাড়ে না, সে কথাই উঠে এসেছ ছবিটি তা বিশ্বাসযোগ্য ভাবে ব্যক্ত করে। সব সংকটেও একজন মহিলা প্রতিমুহূর্তে নিজেকে একাই মনে করেন। ছবিটি প্রশ্ন তুলে দেয় ডিভোর্স পরবর্তী জীবন নিয়ে। ছোট গল্প ফিল্মে ধরা খুব সহজ নয়। সেই সমস্যা ফিল্মটি দেখতে গিয়ে একেবারেই মনে হয়নি। চিত্রনির্মাতা যা দেখেছেন তাই ক্যামেরায় ধরার চেষ্টা করেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে অরুণাকে তিনি একেবারেই অরুণার মধ্যে দিয়ে দেখাননি। তাই বহুল জাম্প কাট দিয়ে তিনি অপরের চোখ দিয়ে তাকে দেখিয়েছেন। গোটা কাহিনি শেষ পর্যন্ত থেকে যায় সম্ভাবনায় মুখর। সারাদিনের কাজ নতুন ভাবে শুরু করেও যেন নতুন নয়। 

পর্ব ২ –
এদিনের তৃতীয় ছবি পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র “মাচান” (দ্য স্ক্যাফোল্ডিং)। ছবির চিত্রনাট্য সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। ছবিটি শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষাগত সমস্যাগুলিকে তুলে ধরে এবং যেসব পরিবারের সামান্য সংস্থান আছে এবং যাঁদের নেই, উভয় ধরনের পরিবারগুলির মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরে।

ছবিটি শুরু হয় একটি ‘প্রকল্প অঞ্চলের’ জনবসতিকে কেন্দ্র করে, যার কাঠামোয় শ্রমজীবীর ছাপ স্পষ্ট। নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষ ও অস্থায়ী (প্রকল্পের ইঁট দিয়ে ঘেরা) ঝুপরিবাসী নিম্ন-বিত্তদের প্রায় পাশাপাশি অবস্থান।

দু’টি পরিবারকে ধরে তৈরি হয়েছে ফিল্মটি। একদিকে একটি শিশুর স্কুল যাওয়া, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া, ক্লাসে পড়াশোনা, বন্ধুদের সঙ্গে টিফিন খাওয়া এবং শেষে বাড়ি ফেরা। অপর দিকে আরেকটি শিশুর সারাদিন খেলা, বালিতে ঝাঁপানো, পুরোনো ফেলে দেওয়া টায়ার নিয়ে মজে থাকা, তামাক চিবোনো, অস্তগামী সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত ধুলো ওড়ানো। যে জীবনে কোনও স্কুল বা শিক্ষা নেই, তার প্রয়োজনীয়তাই অনুভূত হয়নি। 

একদিকে যখন বাড়ি ফিরে রাতের খেতে বসা, খাওয়ার আগে প্রার্থনা; তখন অন্যদিকে ঘরে অশান্তি, মজুরি না পাওয়া, কোনরকমে আধপেটা খাওয়া, ঠিকাদারের দেওয়া টাকা নিয়ে অসন্তোষ, কাঠকুঠো কুড়িয়ে ভেঙে জ্বালানি জোটানো।

কিন্তু এরপরেই গল্প অন্যপথে ঘোরে, স্কুলছুট শিশুটি স্কুলে ভর্তি হয় এবং ক্রমে অপর ছেলেটির বন্ধু হয়। তার দক্ষতাও প্রকাশ পেতে থাকে। মধ্যবিত্ত পরিবারটিতে সে সহজেই গৃহীত হয়। কিন্তু একদিন ওই প্রকল্পটির ঠিকাদার টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। ছেলেটি স্কুল থেকে বেরিয়ে দেখে তার অভিভাবকরা সব কিছু গুছিয়ে চলে যাচ্ছে।

কাহিনি এই সমাজের স্বাভাবিক ঘটনাই দেখিয়েছে। বিশাল অংশের শিশুরা শিক্ষার আলোই পায়না। তারা যোগ্য কি অযোগ্য তার বিচার কে করবে?

পর্ব ৩ –
মধ্যাহ্নবিরতির পর তৃতীয় পর্বের শুরুতেই দু’টি স্বল্পদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র। অনন্ত দাস শাহনির ছবি “নঙ্গী ভিত” (নেকেড ওয়াল) এর প্রথম দৃশ্যই বুঝিয়ে দেয় এই ছবি নিছক কাহিনিচিত্র নয়, ইমেজারি এই ছবিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।

স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে জেগে ওঠে গুড্ডু। প্রেমের স্বপ্ন। উদ্ভিন্ন যৌবন কোনো বাধা মানে না, কারণ তার চালিকাশক্তি প্রেম। গুড্ডুর তিন ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই প্রেমে পড়েছে। বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে তার সন্তর্পণ কথোপকথনে পরিচালক বুঝিয়ে দেন যে এই প্রেম কোনো অবাধ ভালোবাসা নয়। তাতে দুশ্চিন্তা, অনিশ্চয়তা এবং ভয় মিশে আছে। তাই গুড্ডু যখন একটি মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়, যে মেয়েটি আসলে মুসলিম, সে স্বাভাবিক ভাবেই ভয়ংকর দোটানায় পড়ে যায়। বয়ঃসন্ধিকালের অন্তর্নীল রোমাঞ্চ যেমন বারবার তাকে সমাজ-নিষিদ্ধ প্রেমের কাছে ফেরত যেতে আকর্ষণ করে, তেমনই আবার ধর্মীয় বিভাজনের যে সামাজিক নিষেধ, তার প্রভাবে কিছুতেই সে স্বাভাবিক ভাবে এগোতে পারে না। তার আরেক ভাই তাকে সাহস যোগালেও সে মেয়েটিকে তার ভালোবাসার কথা বলে উঠতে পারে না, এমনকি মেয়েটির তরফ থেকে ইঙ্গিত আসা সত্ত্বেও। তাকে তাড়া করে চলে একটি দোটানা মিশ্রিত ভয়। রোমাঞ্চ এবং ভয়ের মিশেলে তৈরি এই ছবি মনে করিয়ে দেয় ভ্লাদিমির লেনিন আর ক্লারা জেটকিনের আলোচনা, প্রেমের স্বাধীনতা নিয়ে। লেনিন বলছেন প্রেমের স্বাধীনতার জন্যে এক আবশ্যিক প্রয়োজন পিতা মাতার শাসন থেকে মুক্তি। এখানে সমগ্র গ্রামসমাজ এই পিতা মাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ। যার ফলে শাস্তি পেতে হয় গুড্ডুর এক ভাইকে। প্রায় সারাটা সময় ধরে স্কুল ইউনিফর্ম পরে কুশীলবদের অভিনয় কখনো অভিনয় মনে হয় নি, তারা এতটাই সাবলীল। মনে হচ্ছে যেন ডকুমেন্টারি দেখছি। ছবি শেষ হয় এক আশাব্যঞ্জক দ্যোতনায়। গুড্ডুর ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন আবার চলে আসে ছবির ফ্রেমে।

গ্রামসমাজের চোখরাঙানি আর পঞ্চায়েতের বিধান সত্ত্বেও, প্রেম জেগে থাকে আরেক আরম্ভের জন্যে, তাকে তুমি যত রক্তাক্তই করোনা কেন। এমনকি হাওয়া বেলুন উড়ে গেলেও। অনন্ত দাস শাহনিকে এই চিত্রায়নের জন্য অভিনন্দন।

পরের ছবিটি অসমের চিত্রনির্মাতা অনুনয় বড়ভুঁইয়ার “ভিজা নীল তেরপল” (ওয়েট ব্লু টারপলিন)। এই ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দর্শক খোঁজার চেষ্টা করে যাবে এক নীল ত্রিপল, সেটাই পরিচালকের অন্যতম প্রচেষ্টা। কেন খুঁজবে, আর কেনই বা তাকে পাবে না, সেখানেই এই ছবিটির মূল সুর লুকিয়ে আছে। আসামে যখন এনআরসি চলছে, সেসময় একজন পরিযায়ী শ্রমিক তার পরিবার ফেলে চলে এসেছে মুম্বাইতে, সুদূর অসম থেকে। ছবিতে সারাক্ষণ তার উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তা তাকে তাড়া করে বেড়ায়। যেখানে সে কাজ করে তারা যথেষ্ট সহৃদয়। তার নানা উদ্বেগের খবর নেয়। এমনকি তার একটি ভুয়ো পরিচয়পত্র বানানোর আগ্রহ প্রকাশ করে যাতে তার কোন সমস্যা না হয়। কিন্তু উদ্বেগ কমে না। ফোন সে খবর পায় তার বউয়ের নিয়ে যাওয়া কোন কাগজ কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেনি। উদ্বেগ ক্রমশঃ ভয়ে রূপান্তরিত হয়। নিস্তব্ধতা খানখান হয় কুকুরের চিৎকারে, আর তখনই গৃহহীন মানুষের একমাত্র সহায় নীল ত্রিপল এর পরাবাস্তব আবির্ভাব ঘটে দর্শকের মননে।

সারা ছবি জুড়ে অনুনয় যেভাবে গল্পটা বললেন সেটা অভিনব। কথোপকথনে এমন বেশ কিছু প্রশ্ন উঠে এলো যেটা দর্শকরা অবশ্যই উপভোগ করেছেন। বিশেষ করে একটি বিড়ালের উপস্থিতি এবং কাহিনির প্রধান চরিত্রের সাথে গড়ে ওঠা প্রাণীটির সখ্যতা এবং শেষ দৃশ্যে কুকুরের চিৎকার দর্শকদের অবশ্যই ভাবাবে। প্রশ্ন এলো মূল চরিত্রের অস্পষ্ট ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে, যেটার অনুনয় খুব ভাল ব্যাখ্যা দিলেন। তার বক্তব্য, তিনি এনআরসির সময়ে লক্ষ্য করেছেন যে তারাই সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যারা সমাজের খেটে খাওয়া নিচুতলার মানুষ, যেখানে ধর্মের মুখ্য কোন ভূমিকা ছিল না। তাই তিনি মূল চরিত্রের পরিচয় খুব স্পষ্ট করেন নি। তুমুল হাততালি দিয়ে শেষ হয় অনুনয়ের ছবি “ভিজা নীল তেরপল”।

পর্ব ৪ –
মধুলিকা জালালি একজন কাশ্মীরি পণ্ডিত। ১৯৯০ সালে যখন মধুলিকা খুব ছোট, তখন তাদের পরিবার মানে বাবা, মা আর তার দুই বোন কাশ্মীর থেকে পালিয়ে আসেন। বিশ বছর পরে মধুলিকা তাদের পরিবারের সাথে আবার কাশ্মীরে যান। তাদের এই যাত্রাকে তিনি ক্যামেরায় ধরেন। বাবার আনন্দ , উচ্ছলতা, তার মধ্যে এক নতুন অনুভূতি তৈরি করে, সেটা হলো ঘরে ফেরার অনুভূতি। এই অনুভূতিকে নিয়ে তৈরি তার এই পূর্ণদৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র। প্রথমবার যখন তারা কাশ্মীরে যান, তখন তারা তাদের নিজেদের ঘর খুঁজে পান নি। শুধু তাই নয়, মধুলিকা বহু চেষ্টা করেও তাদের পুরনো বাড়ির কোন ছবিও খুঁজে পান নি। তার বাবাও পুরনো ঘর খুঁজে পাওয়া নিয়ে নিশ্চেষ্ট ও উদাসীন ছিলেন। মধুলিকার মনে এই অধরা ঘরের ঠিকানা এক গভীর অতৃপ্তির জন্ম দেয়। সেই সময়টাকে ধরার জন্যে, তাদের পারিবারিক ইতিহাস জানার জন্যে, তার খোঁজ শুরু হয়। তাদের পরিবারের বিভিন্ন মানুষজনকে তিনি প্রশ্ন করেন, বিভিন্ন ছবি দেখেন। শেষপর্যন্ত মধুলিকা তার বড় দিদিকে নিয়ে পৌঁছোন তাদের সে বাড়িতে। ততদিনে তাদের বাবা মারা গেছেন। তাদের বাড়ি সে সময়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে এখন এক নতুন বাড়ি। যার সাথে দিদি তাদের বাড়ির বিশেষ মিল খুঁজে পায় না। বরঞ্চ তাদের বাড়ির ঠিক পাশেই তাদের বাবার এক বন্ধুকে তারা পায়। আর পায় এক অদ্ভুত আত্মীয়তা, যা তাদের বাড়ি খুঁজে না পাওয়ার শোক ভুলিয়ে দেয়। এই আত্মীয়তা যে কোন ধর্মের বাধ মানে না। মানুষে মানুষে এই সখ্যতা এমন এক চিরকালীন সত্য যে তাকে কোন হিংসা বা বিচ্ছেদমূলক রাজনীতি দিয়ে আটকানো যায় না। মধুলিকা শেষ পর্যন্ত খুঁজে পায় তাদের বাড়ির ছবি। কাশ্মীর নিয়ে আজকের ভয়ংকর বিদ্বেষমূলক এবং ধর্মীয় ঘৃণার পরিবেশে এই ছবি ব্যাক্তিগত যাত্রায় খুঁজে নিতে চায়, যে সমস্ত দুঃখ যন্ত্রণার শেষেও মানুষে মানুষে সম্পর্কে শেষ পর্যন্ত প্রেম এবং সখ্যতাই বেঁচে থাকে। এবং ইতিহাসের কোন এক সময়ে আক্রান্ত এক জনগোষ্ঠীর ক্ষতের খতিয়ান তারা নিজেরাই নিজের মতো করে ফিরে দেখবেন। বহুস্বরে। সমস্ত সামাজিক-অর্থনৈতিক জটিলতা নিয়েই। কোন এক চাপিয়ে দেওয়া অভিসন্ধিমূলক একরৈখিক ন্যারেটিভ তাদের সে বহুমাত্রিক স্মৃতিকে নিজের লাভের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারবে না।

“‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? / কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!”
নজরুল ইসলামের কবিতার এই লাইনগুলো পড়তে পড়তে আমরা বড়ো হয়ে উঠেছি। ছোট থেকে জেনে এসেছি ধর্মের নাম বিভেদ করা যায় না; তা ঘোরতর অন্যায়। আমাদের ছোট থেকে বড়ো হয়ে ওঠার ধাপগুলোতে; শৈশব থেকে কৈশোর হয়ে যৌবনে পদার্পণের সময়ে পড়াশোনা, খেলাধুলা, প্রেম- সবই ছিল; কিন্তু ছিল না শুধু সাম্প্রদায়িকতা। অন্তত রাখঢাকহীন ভাবে। ভিতরে ছিল কি? ছিল নিশ্চয়ই। এই নিয়েই কস্তুরী বসু এবং দ্বৈপায়ন ব্যানার্জির তথ্যচিত্র “এ বিড ফর বেঙ্গল”; যা দেখানো হল অষ্টম কলকাতা পিপলস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের শেষ দিনের চতুর্থ পর্বে।

ভারতের স্বাধীনতা এসেছিলো পাঞ্জাব ও বাংলার বিভাজনের ওপর ভিত্তি করে। তার ফলস্বরূপ বিভাজনের সময়ে হাজার হাজার মানুষ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত হন। তা’সত্ত্বেও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির মৃত্যুর পর বাংলার রাজনীতিতে তেমন করে নিজেদের ছাপ ফেলতে পারেনি সাম্প্রদায়িক আরএসএস। এমনকি বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়েও শান্ত ছিল বাংলা। তারপর এলো ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচন। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে দেশের ক্ষমতা দখল করলো বিজেপি যার নেতৃত্বে নরেন্দ্র মোদী; যিনি গুজরাট দাঙ্গায় অভিযুক্ত। আর এর পরবর্তীতে বাংলায় হু হু করে বাড়তে শুরু করলো সংখ্যাগুরু হিন্দু ধর্মের সাম্প্রদায়িকতা। গোটা ভারতে জমতে শুরু করলো সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। গোরক্ষার নাম শুরু হল হত্যা। বাড়তে শুরু করলো সংখ্যালঘুদের গণপিটুনিতে হত্যা। বাংলার মাটিও বাদ গেলো না এই আঁচ থেকে। সাম্প্রদায়িক বিজেপি, আরএসএস-এর প্রভাব বাড়তে শুরু করলো এই বাংলায়। গোরক্ষার নামে খুনও হলেন পাঁচ জন সংখ্যালঘু মানুষ। কিছু জায়গায় হতে লাগল স্থানীয় দাঙ্গা – দোকান ভাঙচুর, বাড়িতে আগুন, খুন। এই আবহেই এলো ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচন। হিন্দুত্বের হাওয়ায় ভর করে ইতিহাসে প্রথমবার ১৮টি লোকসভা আসন জয় করলো বিজেপি। এই সবকিছু নিষ্ঠার সাথে ক্যামেরায় ধরেছেন দুই পরিচালক। নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনকে অন্যতম সূত্র ধরে তাঁরা খুঁজে বেড়িয়েছেন এই হিংসা আর ঘৃণার উৎস।

২০১৯ এর পরবর্তী সময়ে নাগরিকত্ব নিয়ে লড়াইয়ের কথা উঠে এসেছে এই ছবিতে। ২০২১-এ বাংলার বিধানসভা নির্বাচনের আগে নাগরিক সমাজ ও গণআন্দোলন কর্মীদের রাজনৈতিক প্রচার “নো ভোট টু বিজেপি”-র কথাও উঠে এসেছে ছবিতে। ছবির দুই পরিচালক সিএএ, এনআরসি, এনপিআর বিরোধী লড়াই এবং ফ্যাসিবিরোধী ক্যাম্পেনে অংশ নিয়েছেন, চিত্রনির্মাতার “পর্যবেক্ষক” ভূমিকার “নিরপেক্ষতা”কে দূরে সরিয়ে রেখে। বাংলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হওয়ার যে ভয় পেয়ে সাধারণ মানুষ এই কালপর্ব জুড়ে বার বার ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন, সেই ভয় যে দুই পরিচালকের মধ্যেও কাজ করেছিলো, তাও প্রকট হয়ে ওঠে এই ছবিতে। ২০২১ এ বাংলার নির্বাচনে বিজেপির পরাজয় তাৎক্ষণিক এক স্বস্তি দেয় বাংলার মানুষদের। সেই শ্বাসটুকুর সাথে সাথে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা মিশে থাকে। ছবিতে বার বার মুছে যায় ব্যক্তিগত জীবন আর ছবির রুপোলি পর্দার মধ্যের ফারাক।

ছবির মধ্যে বাংলার গোরক্ষক বাহিনির গরুগণনার অদ্ভুত দৃশ্যে দর্শকরা হাসিতে ফেটে পড়েন। আবার শেষে যখন ছবির সঙ্গে যুক্ত কলাকুশলীদের নাম পর্দায় দেখা যাচ্ছে আর সঙ্গে মৌসুমী ভৌমিকের কন্ঠে শোনা যাচ্ছে “অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত”; হাততালিতে ফেটে পড়ে কানায় কানায় ভর্তি প্রেক্ষাগৃহ। মনে হচ্ছিলো “নিদ্রিত ভারত” সত্যিই জেগে উঠছে হয়তো। ছবির শেষে কস্তুরী বসু এবং দ্বৈপায়ন ব্যানার্জি দর্শকদের সঙ্গে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। দর্শকদের মধ্যে থেকেও উঠে আসে অনেক প্রশ্ন, অনেক বক্তব্য। পুরো ছবি জুড়ে পরিচালকের ক্যামেরা ঘুরে বেরিয়েছে বিজেপির নির্বাচনী অফিস, ভিএইচপি-র কেন্দ্রীয় অফিস ও ট্রেনিং ক্যাম্প, বিজেপির আইটি সেল সহ বিভিন্ন জায়গায়। নাছোড় সত্যানুসন্ধানে অতীত থেকে বর্তমান খুঁজে বেড়িয়েছেন চিত্রনির্মাতারা। ছবির শেষে চিত্রনির্মাতারা মনে করিয়ে দেন যে সামাজিক হিংসার এই বিভাজন আজকের নয়, বহু পুরনো, অতীতের বিভাজনরেখাগুলি ভঙ্গুর ভাবে জোড়াতালি মারা, তাই হেঁচকা টানে ভেঙে পড়তে পারে যে কোনও সময়। এতদসত্ত্বেও মনে পড়ছিল কবি সুকান্তর কবিতার কিছু লাইন- “বন্ধু, তোমার ছাড়ো-উদ্বেগ, সুতীক্ষ করো চিত্ত, / বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত”

পর্ব ৫-
“সো চাদার সুর নর মুনি ওঢ়ে”। নানা পরতের, বিরাট চাঁদোয়ার এই শহরটা খুব কাছের অথচ বাড়ি বাড়ি ঢুকে পড়ছে না ক্যামেরা। সম্মানজনক দূরত্ব রেখে তাকিয়ে থাকছে। কী ধরা পড়ছে তবে এমন সব অবলোকনে? মন্দিরের ঘন্টা বাজছে, ওই শোনা যায়! মানুষের ভিড়ে উপচে পড়ছে গঙ্গার ঘাট, সাদা পাখিগুলো নৌকা-বজরায় এসে ঝিমোচ্ছে আর এসবের মধ্যেই রানি বলে মেয়েটি বিয়েবাড়ি সহ নানা ‘অর্কেসট্রা ডান্স’ অনুষ্ঠানে নেচে টাকা রোজগার করছে আর সাদাব বলে ছেলেটি শাড়ি বুনছে। পেটের দায় যে! রানিকে তো নিজের মূক-বধির কন্যাসন্তানটিকে ভাল করে লেখাপড়া শেখাতে হবে। সে জন্যে এলাকার রাজনৈতিক নেতাকে নিজের শরীর বেচতে সে দ্বিধা করে না। কেন করবে? খাওয়াবে কে? তাকে যে নামও করতে হবে, আর অনেক টাকা না করলে এই নরকের শহরটা থেকে দূরে যাবে কী করে? তবে এ স্বপ্নের সহযোগী আছে। মুস্তাফা। রানিকে কেউ ছুঁলে রাগ হয় তার, রানি আর রানির মেয়ে পিঙ্কিকে নিয়ে নৌকায় নদীবক্ষে সে সন্ধ্যাবেলা ঘুরে বেড়ায়, সাদা চাদরে জড়িয়ে নিতে চায় মা আর সন্তানটিকে। সে খুব ভালবাসে। খুব ভালবাসে সে! এমনই চাদর নাকি শাড়ি নাকি যে কোনও বস্ত্রখন্ডই, তবে উষ্ণ ভালবাসামাখা, জড়িয়ে দিতে চায় সাদাব তার ইজরায়েল থেকে আসা বান্ধবীকে। আডা নামের মেয়েটি মৃত মা-বাবার, পরিবার বলতে শুধু ঠাকুমার, সাদাবকে নিয়ে বেনারসের অলিগলি ঘোরে। সাদাবকে – কম কথার, ম্যানেকুইনকেও আলতো করে শাড়ি পরানোর, নরম মনের সাদাবকে – আডা সময় দেয় আর সাহচর্য; কেউ কখনও যা দেয়নি তাকে। মূল চরিত্র আর আশপাশের মানুষেরাও আসলে এ নির্মাণে প্রধান নয়। সব চরিত্র কাল্পনিক হলেও গভীর বাস্তবকে পেটে করে প্রধান হয়ে জেগে থাকে এই বেনারস শহরটা। সেই বেনারস, যাকে মন্দিরের শহর করে গড়ে তোলবার একরৈখিক চেষ্টা সরকার আর তার হিন্দুত্ববাদী দলটা ক্রমাগত চালিয়ে গেলেও আসলে সেই শহর রানি, সাদাব, পিঙ্কি, মুস্তাফা, তিওয়ারি সবাইকে নিয়েই বহুধা বিস্তৃত। এ শহরের গায়ে যে কবীরের দোঁহা লেগে। অষ্টম কলকাতা পিপলস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের শেষ ছবি রীতেশ শর্মা-র “ঝিনি বিনি চাদরিয়া” যা সকল দর্শককে যুগপৎ মুগ্ধ আর আবিষ্ট করে।

নিখুঁত নির্মাণ বললেও কম বলা হয়। অভিনয়, চিত্রনাট্য, ক্যামেরা, সম্পাদনা, কোথাও কোনও ফাঁক নেই এবং কী সাংঘাতিক চাপা আবেগ! কী সাংঘাতিক সৌন্দর্যমন্ডিত দু’টি নিবিষ্টদৃশ্যও এমনকি! আর ওই যে দুটি দৃশ্য যেখানে সাদাব আডাকে নিজের মা-বাবার মৃত্যুর ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছে, কেউ কারও ভাষা পরিষ্কার জানে না অথচ সহমর্মিতায় বুঝে নিচ্ছে বাবরি মসজিদ-দাঙ্গা-ইতিহাস কিংবা মুস্তাফা পিঙ্কিকে রানির জন্য আনা বড় শাড়িটা নিজে হাতে পরিয়ে পরম পিতৃত্বে জড়িয়ে নিচ্ছে – এমন সব দৃশ্য ভারতীয় হিন্দি ছবিতে আমরা বহু, বহুদিন দেখিনি। পরিচালককে কুর্নিশ। আশা রাখি, রীতেশ অনেক দূর যাবেন আর তুলে আনবেন এমনই সব জানা অথচ একেবারেই অচেনা হয়ে দ্রুত বদলাতে থাকা শহরগুলোর আখ্যান। 

লেখা – সুমিত, অনিন্দ্য, সব্যসাচী, ভাস্কর
ছবি – নিবেদিতা, সায়ন

অষ্টম কলকাতা পিপল্‌স ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল
৩১শে মার্চ – ৩রা এপ্রিল ২০২২
উত্তম মঞ্চ, হাজরা
প্রবেশ অবাধ

0 replies

Leave a Reply

Want to join the discussion?
Feel free to contribute!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *