।। ১৯ জানুয়ারি, ২০১৮।।

,

এই কোলকাতার ভিতরে আর এক কোলকাতার গল্প। যাঁরা প্রতিদিন ট্রেনে ট্রেনে ফেরি করে বেড়ানকোথায় যান তাঁরা,কীভাবে দিন কাটান তার গল্প। শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার অসংখ্য কোলাহলের মধ্যেই একজন বলে ওঠেনতাঁদের মূল সম্বল তাদের পণ্য নয়ভাষা, তাঁরা যেভাবে ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলেন সেটা। আরেক হকার চন্দন দড়ি দিয়ে সাপের খেলা দেখানগলার মধ্যে ঢুকিয়ে নেন ছুরিতাঁর ভাষায়আনন্দ ফেরি করেন। ম্যাজিক দেখিয়ে অবসরে দিন গুজরান করেন। তাপস,যিনি ট্রেনে ট্রেনে গান গেয়ে বেড়ানঅবসরে তিনিই নবকুমার,তিনিই প্যারোডি বাঁধেন সরকারবিরোধী। সরকারী অবহেলা, যা পরিবর্তন পরবর্তী বাংলায় আরও ভয়ঙ্কর রূপ নেয় এবং হকার উচ্ছেদহকারি কে বেআইনি করে দেওয়ার জাঁতাকলে এক হকারের মুখে শোনা যায় অমোঘ উচ্চারণ, আমার সরকারী চাকরীর মতো সবেতন ছুটি নেই, আমি চলমান জনযুদ্ধ।

দ্বিতীয় দিনের প্রথম ছবি ছিল অসংগঠিত শ্রম ক্ষেত্রের চলমান হকার দের উপর নির্মিত প্রথম ছবি, দ্য রানিং হকার। ছবি পরবর্তী আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন পরিচালক অভিজ্ঞান এবং চন্দন, আর সিনেমার পর্দা থেকে স্টেজে উপস্থিত ছিলেন তাঁদের ছবির মূল চরিত্ররা, যাঁরা এখনো ফেরি করে একই প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। 

 

কীভাবে মিলে যায় থিয়েটার আর আমাদের দুনিয়াছোট্ট এক নাট্য উদ্যোগের মাধ্যমে মণিপুরের কথা কি করে সারা দেশের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়সাবিত্রী, কানহাইলালের জীবন সংগ্রামের সাথে রাজনীতির সম্পর্ক ঠিক কিফুটিফাটা মাটির এক চিলতে চারাগাছ আর সাবিত্রী হেইনামের কান্নায় ফুটে ওঠে মেমোয়ার্স অফ আফ্রিকা। আর ঘন সবুজ ঘাসের সামনে উজ্জ্বল সাবিত্রী বলতে থাকেন নাট্যজগতের সঙ্গে তাঁর চলাচলের কাহিনী, যাতে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে নাটকের নিত্যনতুন কৌশল, মণিপুর আর কানহাইলাল । কীভাবে পরিচালক বলেন তাঁর কলাকুশলীদের কীভাবে কাঁদতে হবে? কীভাবে শরীরকে করে তোলা যায় আরো বেশি নমনীয়?

একই সাথে নাট্যচেতনা এবং কৌশল, ব্যক্তিগত ও রাজ্য রাজনীতির মিলন ঘটায় দ্বিতীয় ছবি থিয়েটার অফ দ্য আর্থ। হিন্দী আগ্রাসনের মুখে নাটক পরিচালনারমণিপুরী জনগণের কাছে নাটকের এক অন্য ভাষা পৌঁছে দেওয়ার লড়াই। পরিবারের সম্মুখে আহানজাওবিকে আর্মির ধর্ষণের কাহিনী সাবিত্রী মহাশ্বেতা দেবীর গল্পের আঙ্গিকে তাঁর বিখ্যাত দ্রৌপদী নাটকে ফুটিয়ে তোলার ৪ বছরের মাথায় আসাম রাইফেলস এর সামনে আর্মি অত্যাচারের প্রতিবাদে মণিপুরের নগ্ন মহিলাদের সর্বখ্যাত আন্দোলনে মিশে যায় মঞ্চ ও বাস্তব। যে নারীদেহ ক্ষমতা দখলের প্রশ্নে চিরকাল শাসকের প্রথম লক্ষ্য হয়ে এসেছে, তার রাজনীতি প্রকট হয়ে ওঠা সাবিত্রীর জীবন ও জীবিকায়।

 

দ্বিতীয় দিনের তৃতীয় ছবি তরুণ ভারতিয় পরিচালিত, লা মানালা মানা খাসি ভাষার একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দবন্ধ, যার অর্থ জনসমক্ষে যা কিছু নিষিদ্ধ, তরুণ এই ছবিটিতে এই শব্দ বন্ধের মাধ্যমে খাসি জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন বেঁচে থাকার লড়াই কে তুলে ধরেছেন, ভারত রাষ্ট্রের কেন্দ্রীক আগ্রাসনের মানচিত্রে। এই তথ্যচিত্রটি বর্তমান খাসি গোষ্ঠীভুক্ত লোকজনের ব্যক্তিগত জীবন এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক নথিপত্রের মধ্যে, ফেসবুক ও ফুটেজের মধ্যে অনায়াস বিচরণের মাধ্যমে অতীত ও বর্তমান কে এক ফ্রেমে তুলে ধরে, এবং তরুণ খাসি গোষ্ঠী ও তাদের আধুনিক গানের আবহে এক অদ্ভুত বুননের মাধ্যমে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় এই সমস্ত জনগোষ্ঠীর বিলুপ্তির প্রশ্নের সামনে। তা সত্ত্বেও ছবিটি জীবনের বিভিন্ন সূক্ষ্মতার প্রশ্নে যথেষ্ট যত্নশীল। মাতৃকেন্দ্রিক গোষ্ঠী হয়েও যে খাসি মাতৃতান্ত্রিক নয় বরং পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ছবির চলাচলে।

 

৪ এবং ৫

১৪৪ ধারাসরকার আর সরকার পরিবর্তনের মাঝখানে আটকে ভাঙরের মানুষ এবং তাদের জমি অবাধে অধিগ্রহণ। আর তারই প্রতিবাদে পাওয়ার গ্রিডের বিরুদ্ধে লড়াই এবং সরকারের নির্মম অত্যাচার। মাওবাদীবহিরাগত তকমা এবং আইনের জাঁতাকলে আটকে ভাঙরের মানুষ আসলে কেমন ভাবে দিন কাটাচ্ছেনতারই প্রতিচ্ছবি নিয়ে হাজির ছিল দুটি ছবি, পিপলস মিডিয়া প্রযোজিত টাইমলাইন ভাঙর এবং মিতালী বিশ্বাসের পরিচালনায় হেই সামালো।

ভাঙরের সাধারণ অধিবাসী থেকে অলীক শর্মিষ্ঠার মতো পরিচিত রাজনৈতিক কর্মীদের সাথে কথোপকথন এবং তার বিপরীতে শাসক গোষ্ঠী তৃণমূল এবং তার পূর্বে বামফ্রন্টের অসততা এবং দমন পীড়ন তীব্রভাবে ফুটে উঠেছে দুটি ছবিতেই। যাবতীয় মিথ্যা প্রচারের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মিথ্যে, এবং সেই ভাবনাহীন ‘উন্নয়ন’-এর ফলে আসলে কাদের সুবিধা হচ্ছে আর কারা স্থায়ী ভাবে তাঁদের জীবিকা থেকে উচ্ছেদ হচ্ছেন তার স্বরূপ নিয়ে এখনো সমাধান খুঁজে না পাওয়া ভাঙর।

 

“সেই সময়ে হঠাত করে শুনতে পেলাম সুর, ভূপেন হাজারিকার গলা, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের”

এর পরের ছবি রঙিলী বিশ্বাসের আ সং ফর এভরিওয়ান, যাতে আসাম আই পি টি এ-র ইতিহাস কে তুলে ধরতে চেয়েছেন পরিচালক, হেমাঙ্গ বিশ্বাস এবং ভূপেন হাজারিকার কাহিনীর মাধ্যমে। ষাটের দশকের ভাষার দাঙ্গা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে পিস মিশন এবং আসামে আই পি টি এ-র বিভিন্ন কনভেনশন এবং অনুষ্ঠানের ইতিহাস কে তুলে ধরেছেন। আসামের সাম্প্রতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে দাঙ্গা পরবর্তী ইতিহাস। যে ইতিহাস লেখা হয়নি, সেই ইতিহাস এখন নতুন করে লেখার প্রয়োজন, আর সেই কাজটিই করেছেন পরিচালক।বর্তমান আসামের সমস্যাদীর্ণ অবস্থা তুলে ধরেছেন স্মৃতি-বিস্মৃতি এবং ইতিহাসের মাঝখানে গান-কে কেন্দ্র করে এক অন্য ইতিহাস লেখার মাধ্যমে।

পরিচালকের সঙ্গে ছবি পরবর্তী আলোচনায় উঠে আসে ভিসুয়াল মাধ্যম থেকে আসাম বাংলা টানাপোড়েন, আগেকার বামপন্থী সাংস্কৃতিক উদ্যোগ এবং বর্তমান, যে ইতিহাস লিখিত নয় তাকে সংরক্ষণ কীভাবে করা যেতে পারে সহ বিভিন্ন প্রশ্ন। 

 

দ্বিতীয় দিনের এর পরবর্তী আলোচনা ছিল তনিকা সরকারের কি নোট বক্তব্য।

 

আজকাল নিত্যনতুন মর্মান্তিক ঘটনার উপর্যুপরি আঘাতে আমরা আর কিছুতেই শকড হইনাআতঙ্ক বোধ করিনা আর। প্রতিমুহূর্তে পাল্টাচ্ছে আমাদের স্বাভাবিকতার সংজ্ঞা। লিভিং ইন হিন্দু রাষ্ট্র শীর্ষক বক্তব্যে তনিকা সরকার প্রশ্ন তোলেন হাদিয়া থেকে আফরাজুলমৌলবাদ থেকে সংরক্ষণবাদ নিয়েপ্রশ্ন তোলেন এক হিন্দু রাষ্ট্রে মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার এবং বাস্তবতা নিয়ে। আসলে কি গুজরাত সত্ত্বেও মোদী জিতেছেন নাকী গুজরাত করেছেন বলেই মোদী জিতেছেন, ভয়াবহতার সামনে লোককে স্তম্ভিত করে দিয়ে? প্রোফেসর সরকার শিহরণ জাগান আর এস এস এবং বিজেপি-র কাজকর্মের মধ্যে নাৎসি ছায়া তুলে ধরে, কখনো শব্দবন্ধের প্রয়োগে, কখনো স্ট্র্যাটেজির, কখনো বা একে অপরের নির্লজ্জ প্রশংসায়। আবারও মনে করান, ব্রিটিশ বিরোধী কোনো আন্দোলনে কখনো আর এস এস থাকেনি, কখনো তাদের উপর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দমন নেমে আসেনি, এই দেশভক্তির দামামা-র আড়ালে তাদের আসল স্বরূপ আসলে কি?কীভাবে নির্ধারিত হয় এই মুসলিম ভীতি?কীভাবে নরম এবং উগ্র হিন্দুত্ববাদের মধ্যে আটকা পড়া ভারতীয় রাজনীতিতে কীভাবে আমরা দেখবো সেই বিভিন্ন অপর সত্তাজাতিজনগোষ্ঠী কে?

আবার তুলে ধরেন গান্ধীর সামনে আম্বেদকরের প্রশ্নকেদেশ টা আসলে কাদেরযেখানে প্রতি তিন জনের মধ্যে এক জন হিন্দু বিজেপি কে ভোট করেসেই দেশ কি জন্মসূত্রে হিন্দু নির্ভয়ার ছিল না?

বক্তব্য পরবর্তী আলোচনাও চলে এই হিন্দু রাজকে প্রতিরোধের বিভিন্ন সম্ভবনার প্রশ্নে, যা হতে পারে একই সঙ্গে রাস্তায় নেমে এবং তাদের বিভিন্ন মিথ্যা প্রচারের বিরুদ্ধে পালটা প্রচারের মাধ্যমে। 

 

দ্বিতীয় দিনের শেষ ছবি ‘লুকিং ব্যাক’ সেকশনে ললিত ভচানি-র দ্য বয় ইন দ্য ব্রাঞ্চের পরবর্তী ছবি দ্য মেন ইন দ্য ট্রি। এটি আট বছর পরে আর এস এস-এর স্বরূপ নিয়ে নির্মিত একটি ছবি। আট বছর বাদে পরিচালক ফিরে আসেন নাগপুরে তাঁর আগের ছবির বিভিন্ন বাস্তব চরিত্রের বর্তমান সিনেমায় তুলে ধরতে। একই সাথে বিভিন্ন চরিত্র এবং শুটিঙ্গের জায়গায় গিয়ে পরিচালকের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণের মাধ্যমে রচিত হয় ছবির এক অন্য ভাষা, এক ব্যক্তিগত রাজনীতির পরিসর। অন্য দিকে সেই সমস্ত জায়গা, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট তুলে ধরার মাধ্যমে তৈরী হয় আর এস এস এর বেড়ে ওঠার এক অন্য মানচিত্র, যে মানচিত্রে হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্থান চুঁইয়ে পড়তে থাকে জীবনের সমস্ত আঙ্গিকে। একই সঙ্গে ছবিটি হতাশার মধ্যেও বিভিন্ন প্রশ্ন রেখে যায়, আগের ছবির যে ছোট ছেলেরা আর এস এস এর শিক্ষায় বড় হচ্ছে তারা কি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে সমস্ত হিন্দুত্ত্ববাদী আদর্শ? এই প্রশিক্ষণের বিপরীতে কীভাবে সম্ভব কোনো প্রতিরোধ? ছবিটি, এবং সেই সঙ্গে দ্বিতীয় দিনের সূচী শেষ হয় দর্শকের বিপুল করতালির মধ্য দিয়ে। 

0 replies

Leave a Reply

Want to join the discussion?
Feel free to contribute!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *